জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস

জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস

প্রিয় পাঠকগণ আজকে আমাদের বিষয় বা প্রশ্ন হচ্ছে জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস  । কিভাবে জাদুঘর তৈরি হয়েছে তার সম্পর্কে আজ আমরা জানবো তাই জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস জানার জন্য আর্টিকেল টা ভালবে পড়ুন তাহলে নিশ্চই জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস  সম্পর্কে জানতে পারবেন ।

জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস 

জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস

জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস : 

উত্তর: সুদূর অতীতকালে চিন, মেসোপটেমিয়া, এথেন্স, ম্যাসিডোনিয়া প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রথা প্রচলিত ছিল। কালের অগ্রগতির সাথে সাথে অতীতকালের জাদুঘরগুলি আরো বিকশিত হয়েছে এবং এগুলির বর্তমান যুগের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। International Council of Museum (ICOM) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীর ২০২ টি দেশে ৫৫ হাজারেরও বেশি জাদুঘর রয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা  জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস ও বিকাশের ইতিহাসকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করে নিতে পারি-

ক। পঞ্চদশ শতকের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর বা ‘প্রাচীন জাদুঘর

খ। পঞ্চদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর

গ। আধুনিক যুগে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর বা ‘আধুনিক জাদুঘর’।

ক। পঞ্চদশ শতকের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর বা প্রাচীন জাদুঘর :

যেসমস্ত জাদুঘরগুলি প্রাচীনকাল থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী পর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলিকে ‘প্রাচীন জাদুঘর’ বলে অভিহিত করা হয়। ইতালীর নবজাগরণের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত এই সমস্ত জাদুঘরসমূহ মূলত বিশিষ্ট ব্যক্তিসমূহের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল। এগুলিতে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না।পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘরের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ইনিগালদি নান্না-র সংগ্রহশালাটিকে (Eni galdi Nanna’s Museum)। এটির প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ৫৩০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ। সম্রাট আলেকজান্ডার যখন সাম্রাজ্য বিস্তারে অগ্রসর হন তখন তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা এবং সাংস্কৃতিক স্মৃতি বিজড়িত স্মারকসমূহ সংগ্রহ করেন এবং তাঁর শিক্ষাগুরু এরিস্টটলের কাছে প্রেরণ করতেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এইসব স্মারকগুলি একত্রিত করে আলেকজান্দ্রিয়ায় বিশ্বের প্রথম দর্শনীয় বস্তুর সংগ্রহশালা স্থাপিত হয়। এটি ‘আলেকজান্দ্রিয়া জাদুঘর’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত আলেকজান্ডার থিবস নগরীটি দখল করার পর তাঁর সৈন্যদের কবি পিটারের বাসভবনটি ধ্বংস করতে নিষেধ করেন। তিনি একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে ভবনটি সংরক্ষণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। ইতিহাস-শিক্ষা-সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের যে উদ্যোগ বর্তমানে গ্রহণ করা হয়ে থাকে সম্রাট আলেকজান্ডারকে তার অন্যতম প্রেরণাদাতা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাচীন এথেন্সে একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বহু দুর্লভ গ্রন্থ সংগ্রহ করা হয়। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারও বহু মূল্যবান দ্রব্য ও চিত্রকলার সংগ্রহশালা গঠন করেন। প্রাচীন যুগে মিউজিয়াম বা জাদুঘর গঠনের ক্ষেত্রে সবথেকে অগ্রগতি ঘটেছিল চিনে। খ্রিস্ট-পূর্ব ষোড়শ থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে শাং রাজবংশের আমলে এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। খ্রিস্ট-পূর্ব তৃতীয় অব্দে চিং রাজবংশের আমলে এক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। চিনা সম্রাট সি-হুয়াং-তি বহু মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য সংরক্ষণ করেছিলেন। হান সম্রাট হু-তি চিনের বিভিন্ন প্রদেশের চিত্রকলা ও হস্তশিল্পকে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য একটি আকদেমি গঠন করেন। অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত জাপানের তোবাই মন্দিরে বহু মূল্যবান শিল্প নিদর্শন ও চিত্রকলা সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

খ। পঞ্চদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর:

মধ্যযুগীয় ইউরোপের সংগ্রহশালা ছিল মূলত রাজদরবার এবং চার্চের অধীন। নবম-দশম শতাব্দী নাগাদ ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপের বাণিজ্য বহুদূর প্রসারিত হয়। বাণিজ্যের সূত্রে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মূল্যবান ও অত্যাশ্চর্য দ্রব্য ইতালির বন্দরগুলিতে জমা হত। সেখান থেকে এগুলি রাজকীয় সংরক্ষণাধীনে নিয়ে যাওয়া হত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে চতুর্থ-ক্রুসেডের সূত্রে প্রাচ্যের বহু মূল্যবান নিদর্শন ইতালিতে এসে পৌঁছায়। এইসময়েই কনস্ট্যান্টিনোপলের বিখ্যাত ব্রোঞ্জের ঘোড়া, ভেনিসের সান-মার্কো ব্যাসিলিকাতে (San Marco Basilica) নিয়ে যাওয়া হয়। রেনেসাঁসের সূত্র ধরে সংরক্ষণের ভাবনা গুরুত্ব লাভ করে। ইতালির সাংস্কৃতিক পুনঃ জাগরণের জন্য প্রাচীন বস্তু ও সংগঠনগুলি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নবোথিত বণিক ও ব্যাংকাররা সাংস্কৃতিক নিদর্শনসমূহ যেমন-চিত্রকলা, হস্তশিল্প প্রভৃতির সংরক্ষণে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সীয় ক্যাসিনো দ্য মেডিচি’র সংগ্রহশালাটি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। ১৭৪৩ সাল নাগাদ এই সংগ্রহশালাটি জনগণের উদ্দেশ্যে অর্পণ করা হয়। প্রসঙ্গত রেঁনেসাসের যুগেই সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য জাদুঘর সংক্রান্ত ধারনার উদ্ভব ঘটে। ১৪৭১ খ্রিস্টাব্দে রোমে প্রথম এইরূপ একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ‘ক্যাপিটোলাইন মিউজিয়াম’ নামে পরিচিত। পোপ চতুর্থ সিক্সটাস এই সংগ্রহশালায় বেশ কিছু প্রাচীন ভাস্কর্য দান করেন। ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের উদ্যোগে ‘ভ্যাটিকান মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য এই সংগ্রহশালাটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।হাঙ্গেরির রাজা প্রথম ম্যাথিউস-এর আমলে (পঞ্চদশ শতাব্দী) স্টোমাকথেলি দুর্গে রোমান সভ্যতার নিদর্শনসমূহ এবং বুডাতে চিত্রকলা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান ভিয়েনায় তাঁর দূর্গে বহু দ্রব্য সংরক্ষণ করেন। পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় রুলফ এবং পঞ্চম অ্যালবার্টও সংগ্রহশালা গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ও চিত্রকলার বহু নিদর্শন সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফ্রান্সের সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস তাঁর রাজপ্রাসাদে বহু মূল্যবান চিত্রকলা সংরক্ষণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাজা প্রথম চার্লস কর্তৃক ইংল্যান্ডের প্রথম রাজকীয় সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ইংল্যান্ডের প্রথম জাদুঘরটি হল লন্ডনের রয়েল আরমারিজ’ (Royal Armouries)। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ‘প্রথম আধুনিক জাদুঘর’ বলে বিবেচনা করা হয় ইলিয়ান অ্যাসমোল-এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য অ্যাসমোলীয়ান মিউজিয়াম’। ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জাদুঘরটির সংগ্রহে প্রাচীন মুদ্রা, গ্রন্থ, খোদাই করা ফলক, জৈবিক প্রজাতির বহু নিদর্শন ছিল। রেনেসাঁসের সময়কালে ইতালিতে ব্যক্তিগত সংগ্রহের মধ্যেই আধুনিক পাবলিক মিউজিয়ামের বিকাশের বীজ নিহিত ছিল। ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত সংগ্রহগুলি জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ক্রমশ ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সার্বজনীন মিউজিয়াম সংক্রান্ত ধারনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

গ। সপ্তদশ শতকের পরবর্তী প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর বা আধুনিক জাদুঘরঃ 

পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক জাদুঘরগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে, জ্ঞানদীপ্তির যুগে এবং অষ্টাদশ শতকের পরবর্তীকালে, আধুনিক যুগে।

জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস পর্বের জাদুঘরগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয় : 

১। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে, জ্ঞানদীপ্তির যুগের জাদুঘর: 

১৭৫৩ সালে স্যার হান্স সোয়ান-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে লন্ডনে ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’-এর যাত্রা শুরু হয়। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ফ্লোরেন্সের ‘উফিজি জাদুঘর ‘টি ষোড়শ শতকে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৭৬৫ সালে তা জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানকালের একটি সুবৃহৎ ও সর্বাধিক জাদুঘর ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত ‘লুভ্র মিউজিয়াম’। ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের কালে এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

২। অষ্টাদশ শতকের পরবর্তীকালে, আধুনিক জাদুঘর : 

উনবিংশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সময়কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং নতুন নতুন বহু জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এইকারণে এই পর্বকে ‘জাদুঘরের যুগ’ (The Museum Age) বলে অভিহিত করা হয়। এই কালপর্বে আমেরিকায় এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বহু নতুন জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আধুনিক জাদুঘর হল-ক। ‘দ্য আর্ট ইন্সটিটিউট অব শিকাগো’ (শিকাগো, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ), খ। ‘ডালাস মিউজিয়াম অব আর্ট’ (ডালাস, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ), গ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল (কোলকাতা, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি। এই যুগে প্রাচীন মিশর, গ্রিস, মেসোপটেমিয়া, রোম প্রভৃতি দেশের দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক সামগ্রীর সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপের জাদুঘরগুলির সঙ্গে আমেরিকার জাদুঘরগুলি পাল্লা দিতে শুরু করে। 

শেষ কথা : তাহলে আজকে আমরা জানতে পারলাম জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস । আশা করি আপনাদের জাদুঘর বা সংগ্রহশালা নির্মাণের ইতিহাস  পোস্ট টা পড়ে ভালো লেগেছে ও নানা তথ্য পেয়েছেন

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *