মহেশ গল্পের প্রশ্ন উত্তর

 

মহেশ গল্পের প্রশ্ন উত্তর

মহেশ গল্প | সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর | মহেশ গল্পের প্রশ্ন উত্তর

 

১। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ও মৃত্যুর সাল কত?

উ: জন্ম ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ এবং মৃত্যু ১৬ই জানুয়ারি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ।

২। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পৈতৃক নিবাস কোথায় ছিল?

উ: হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রাম।

৩। শরৎচন্দ্রের পিতা ও মাতা কে ছিলেন?

উ: পিতা- মতিলাল চট্টোপাধ্যায়, মাতা-ভুবনমোহিনী দেবী।

৪। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটি কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

উ: ১৩২৯ বঙ্গাব্দে (১৯২২ খ্রিস্টাব্দে) ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় ‘মহেশ’ গল্পটি প্রকাশিত হয়, এই বছরে ‘পল্লীশ্রী’ পত্রিকায় আশ্বিন সংখ্যাতেও মহেশ গল্পটি প্রকাশিত হয়।

৫। ‘মহেশ’ গল্পটি পরবর্তীকালে কোন্ গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়?

উ: হরিলক্ষ্মী’ নামক গল্পগ্রন্থে। ‘হরিলক্ষ্মী’র প্রকাশকাল ১৩ই মার্চ, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ। হরিলক্ষ্মী’ বইটিতে তিনটি গল্প ছিল। গল্পগুলি হল- ‘হরিলক্ষ্মী’, ‘মহেশ’ এবং ‘অভাগীর স্বর্গ।

৬। ‘মহেশ’ গল্পের ঘটনাস্থল কোন গ্রাম ?

উ: ‘মহেশ’ গল্পের ঘটনাস্থল হল কাশীপুর গ্রাম।

৭। গ্রামের জমিদারের নাম কী?

উ: গ্রামের জমিদারের নাম শিবচরণ।

৮। ‘ওরে ও গফরা, বলি ঘরে আছিস?’— বক্তা কে? বক্তা উপর উদ্দেশ্যে একথা বলেছে?

উ: বক্তা হলেন তর্করত্ন। বক্তব্যটি গফুর জোলার উদ্দেশ্যে।

৯। গফুর জোলার মেয়েটির নাম কী? তার বয়স কত?

উ: আমিনা। আমিনার বয়স বছর দশেক।

১০। সাধ করে আবার নাম রাখা হয়েছে মহেশ! বক্তা কে? কার নাম মহেশ ?

উ: বক্তা হলেন তর্করত্ন। গফুর জোলার পালিত গরুর নাম মহেশ।

১১। মহেশ, তুই আমার ছেলে, তুই আমাদের আট সন প্রিতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস,”—বক্তা কে?

উঃ এখানে বক্তা—গফুর জোলা।।

১২। মহেশকে কারা থানায় দিয়েছিল?

উঃ মাণিক ঘোষেরা লোকেরা মহেশকে থানায় দিয়েছিল।

১৩। কোথাকার খোঁয়াড় মহেশকে খুঁজতে বলা হয়েছিল? খোঁয়াড় কী ?

উ: দরিয়াপুরের ধোঁয়ার। ধোঁয়াড় হল গোরু মোষের বন্দিশালা।

১৪। গফুর এক টাকার জন্য পিতলের থালাটি কার কাছে বন্ধক রাখে?

উঃ বংশীর কাছে গোফুর পিতলের থালাটি বন্ধক রাখে।

১৫। তবু দাপটে তাঁর প্রজারা টু শব্দটি করিতে পারে না—এমনই প্রতাপ।—জমিদারের প্রতাপ কীরূপ?

উঃ জমিদার ছোটো হলেও তাঁর এমন প্রতাপ ছিল যে, প্রজারা টু শব্দ করতে সাহস পেত না। হিন্দু প্রধান গ্রামে বাস করে কসাইদারদের গোরু বিক্রি করার চেষ্টার অপরাধে গফুরকে কানমলা ও নাকখত দিতে হয়। তাছাড়া জমিদারের ডাকে ‘খাজনা দিয়ে বাস করি’ ইত্যাদি বলে প্রতিবাদ জানানোর অপরাধে জমিদারের সদরে তাকে লাঞ্ছনা ও প্রহার সহ্য করতে হয়—এমনই প্রতাপ জমিদারের।

১৬। এ হিদুর গা, ব্রাহ্মণ জমিদার, সে খেয়াল আছে? —উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে সতর্ক করা হয়েছে কেন?

উঃ গফুর মিঞার প্রতিপালিত ষাঁড় মহেশ শেষ বৈশাখের রোদ্দুরে ভাঙা প্রাচীরের ঘা ঘেঁষা একটা পুরাতন বাবলা গাছের ডালে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঠায় বাঁধা। তাকে ঘাস, খড়, জল কিছুই না দিয়ে কষ্ট-যন্ত্রণা দেওয়া হিন্দুদের কাছে পাপ রূপে গণ্য। তাই হিন্দু জমিদারের শাসিত গ্রামে গফুরকে সেই ক্ষমার অযোগ্য পাপের কথা স্মরণ করিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন তর্করত্ন।

১৭। তর্করত্ন দ্বিপ্রহর বেলায় বাটী ফিরিতেছিলেন।”— তর্করত্ন কোথা থেকে বাটী ফিরছিলেন?

উ: কাশীপুর গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং পুরোহিত হলেন তর্করত্ব। তিনি গিয়েছিলেন জমিদার শিবচরণ বাবুর বাড়ি। তাঁর ছোটো ছেলের জন্মতিথি উলপক্ষে পুজো করতে। সেই পুজো সেরেই তিনি নিজের বাটী অর্থাৎ বাড়িতে ফিরছিলেন।

১৮। অন্তঃপুরের লজ্জা সম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছে।”— কোন প্রসঙ্গে লেখকের এই উক্তি ?

উ: গফুর জোলার বাড়ির বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখক এই কথা বলেছেন। আসলে সে বাড়ির মাটির পাঁচিল ভেঙে গিয়ে তার বাড়ির উঠোন এবং রাস্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল। পাঁচিল না থাকায় গফুরের বাড়ির ভিতরটা পথচারীরা তাকালেই দেখতে পেত। আর সেই কারণেই গফুরের অন্তঃপুরের লজ্জাসম্ভ্রম পথিকের করুণার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।

১৯। শুধু চেয়ে থাকে, আর চোখ দিয়ে জল পড়ে।”—কার কথা বলা হয়েছে?

উঃ এখানে গফুরের বৃদ্ধ ষাঁড় মহেশের কথা বলা হয়েছে। আসলে অবোলা প্রাণী মহেশ খেতে না পেলেও কিছু বলতে পারে না, তাই সে কেবল জলভরা চোখে শুধু গফুরের দিকে চেয়ে থাকে।

২০। যেমন চাষা তার তেমনি বলদ – কোন্ প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে?

উঃ বক্তব্যটি তর্করত্নের। অভুক্ত মহেশ চাল-কলার পুঁটুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তর্করত্নের দিকে শিং নেড়ে এগিয়ে এলে তর্করত্ন যেহেতু বিরক্ত হন সেহেতু গফুর তাঁকে জানায় যে, এক মুঠো খেতে চায় মহেশ। গফুরের এই আদিখ্যেতা দেখেই বক্তা প্রশ্নোদৃত উক্তিটি করেছিলেন।

২১। তর্করত্নের তাহাতে করুণার উদয় হইল না;”— তাহাতে বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উ: তাহাতে বলতে এখানে অভুক্ত মহেশের জন্য গফুরের দুঃখের কাহিনি। গফুর মহেশের জন্য পন দশেক খড় ধরে চেয়েছিল জমিদারের কাছে, কিন্তু তিনি তা দিতে রাজি হননি। এমনকী গত সনের বকেয়া বলে কর্তামশায় কাহন খানেক খড় ধরে রেখেছেন। ফলে মহেশ কুটোটিও পায়নি।

২২। তোরা তো রামরাজত্বে বাস করিস ছোটোলোক কিনা, তাই তাঁর নিন্দে করে মরিস। “— বক্তা কে? ‘রামরাজত্ব’ বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে?

উঃ বক্তা হলেন তর্করত্ন। ‘রামরাজত্ব’ বলতে যে শাসনে মানুষ সুখ-শান্তিতে বাস করে, সেই রাজত্বই রামরাজত্ব।

মহেশ গল্পের প্রশ্ন উত্তর

মহেশ গল্পের প্রশ্ন উত্তর | মহেশ গল্প |  রচনাধর্মী  প্রশ্ন উত্তর | বড়ো প্রশ্ন উত্তর

 

 

১। মহেশ গল্পে আমিনার চরিত্র আলোচনা করো। 

উত্তর : সেবাগুণ :  নম্রতা ও সহা শক্তি—চরিত্রের এই বিবিধ গুণের সমারহে ‘মহেশ’ গল্পে আমিনা এক উজ্জ্বল চরিত্র। চরিত্রটি অতি স্বল্প পরিসরে ও স্বপ্ন রেখায় অঙ্কিত হলেও শিল্পী সোনার কাঠির স্পর্শে সে চিরন্তন। গল্পের শুরু থেকে শেষাবধি আমিনার উপস্থিতি। গল্পের সূচনায় তর্করত্নের প্রশ্নের উত্তর দানের সূত্র ধরে তার প্রথম সংলাপ- কেন বাবাকে? বাবার যে জ্বর। এরপর গফুরের উদ্দেশ্যে তর্করত্নের অশোভন গালিগালাজ নিরুপায় চিত্তে সহ্য করে। আমিনা। মাতৃহীন এই বালিকাটি ছোটো হলেও বোধ-বুদ্ধি তার কোনো অংশেই কম নেই। তাই গরু যখন ঘরের চালার খড় ফেরে মহেশকে খেতে দেয়, তখন আমিনা পিতাকে সতর্ক করে বলে দেয়ালটা যে পড়ে যাবে বাবা—” তবে মহেশের প্রতি আমিনার ভালোবাসাও কোনো অংশেই কম নয়। মহেশ হারিয়ে গেলে অসহায় গফুরকে মহেশের খোঁজ আমিনাই এনে দিয়েছে। জ্বরের ভান করে গফুর নিজের ভাত মহেশকে খাওয়ালে, গফুরের অভিনয় সহজেই ধরে ফেলে বুদ্ধিমতী আমিনা। পিতা রাত্রে পুনরায় ভাত রান্নার কথা বললে, আমিনা পিতৃ আদেশ পালন করতে রাজি হয়ে যায়। এসবের মধ্য দিয়ে আমিনা চরিত্রের বিশিষ্ট সেব গুণটি আর অপ্রকাশিত থাকে না। আমিনা সহ্য শক্তিও প্রশংসনীয়। মুসলমান বংশের মেয়ে আমিনার জল সংগ্রহ করে আনার চিত্রে তা প্রকটিত হয়।

আরোও পড়ুন – রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪

অসীম সহা শক্তি নিয়ে আমি সবসময়ই পিতার পাশে থেকেছে। একদিকে সংসারে অম্লভাব ও মহেশের জন্য পিতার আন্তরিক যন্ত্রণা—এই দুয়ের যৌথ কষ্টে সে নীরব থেকেছে। তবে মহেশের মৃত্যু দৃশ্যে আমিনা আর চুপ করে থাকেনি। সে পিতাকে বলেছে— “আমিনা কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, কী করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল। এরপর পিতার হাত ধরে আমিনা ফুলবেড়ের চটকলের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। সবশেষে বলতে পারি, দশবছরের মাতৃহীন বালিকা। আমিনা মাতৃসুলভ সেবাগুণ নম্রতা ও সহ্যশক্তির মধ্য দিয়ে গল্পে মহৎ চরিত্র হয়ে উঠেছে।

 

২। মহেশ গল্প অবলম্বনে তর্করত্ন চরিত্রটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 

 

উত্তর: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে তর্করত্ন চরিত্রটি হিন্দু সমাজপতির প্রতিনিধি হিসাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। সে কুসংস্কারাছন্ন, মানবিকতা বর্জিত হৃদয়হীন এক চরিত্র। গল্পের শুরতে তার প্রথম আবির্ভাব জমিদারবাবুর ছেলের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে পূজা সেরে বাটী ফেরার বর্ণনায়। পূজা করতে যাবার সময় এবং ফেরার সময় গফুরের বাড়ির ভাঙা পাঁচিলের পাশে বাবলা গাছে মহেশকে বাঁধা থাকতে দেখে ভীষণ ক্ষিপ্ত তর্করত্ন গফুরকে শাসিয়ে বলেছে ওটা হচ্ছে কী শুনি? এ হিদুর গাঁ, ব্রাক্ষ্মণ জমিদার, সে খেয়াল আছে?” অর্থাৎ জমিদার হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ, গো-হত্যা হলে গফুরকে যে কঠোর শাস্তি পেতে হবে তা তিনি জানাতে ভোলেন না। কিন্তু সম্বলহীন গফুর অসহায়ভাবে তার কাছে কাহন দুই খড় ধার চাইলে তর্করত্ন তা তো শুধু দিলেনই না তা নয়, উপরন্তু তার নামকরণ নিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকেন ইস! সাধ করে আবার নাম রাখা হয়েছে মহেশ। হেঁসে বাঁচিনে।আবার অভুক্ত মহেশ তাঁর পুঁটুলির দিকে এগিয়ে এলে বলেছে— ” যেমন চাষা তার তেমনি বলদ। খড় ভোটে না, চাল-কলা খাওয়া চাই! তর্করত্নের এই সকল আচরণগুলি থেকে বোঝা যায়, মহেশের জন্য তার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। গো-হত্যার প্রসঙ্গে তার আশঙ্কাটি ছিল শুধুই লোক দেখানো, মেকি। তর্করত্ন যে অমার্জিত মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ তার মুখের ভাষা। সে আমিনার সামনেই গফুরের উদ্দেশ্যে বলেছে ডেকে দে হারামজাদাকে। পাষন্ড। ম্লেচ্ছ। আর গফুরের ব্যাকুল কণ্ঠের অনুকরণ করা কিংবা ধার শোধের প্রসঙ্গে গফুরকে ‘রসিক নাগর’ বলে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে তার অশালীনতার পরিচয় সুস্পষ্ট। জাতপাত ও অস্পৃশ্যতাবোধ বশতঃ তার উচ্চারণ থেকে তার চরিত্রের আর একটি রূপও স্পষ্ট— আ মর ছুঁয়ে ফেলবি না কি? সবমিলিয়ে তর্করত্ন চরিত্রটি ‘মহেশ’ গল্পে নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

১। মহেশ গল্পের ঘটনা ও চরিত্র বিশ্লেষণ করে শরৎচন্দ্রের সমাজচেতনার মানবদরদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দাও।

 

উত্তর : সাহিত্য-কৃতীর উপাদান লেখক সংগ্রহ করেন পারিপার্শ্বিক সমাজ থেকেই। তাই সাহিত্যিকের লেখনীতে সমকালীন সমাজচিত্র ফুটে ওঠা অবশ্যম্ভাবী। সমাজচিত্রের তাই সার্থক রূপায়ণে লেখককে হতে হবে সমাজসচেতন ও সত্যবাদী। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের রচনায় এই সমাজসচেতনতা ও সত্যবাদিতার আদর্শ প্রদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এই জন্যই ‘মহেশ’ গল্পে লক্ষণীয় সমাজের তথাকথিত উচ্চ শ্রেণির অমানবিকতা, অবক্ষয়, বিকৃতি আর সেই সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সমাজের চোখে উপেক্ষিত নিম্নশ্রেণির একটি মানুষের মানবিকতা, উদারতা, মহত্ত্ব। সমাজসচেতন শরৎচন্দ্রের রচনা বর্ণনাত্মক নয়, স্নিগ্ধ মানবতার করুণরসে জারিত হয়ে তাঁর রচনা বাস্তব বর্জিত না হয়েও এক গভীর ব্যঞ্জনায় পরিণতি পেয়েছে। তাই, সমাজসচেতনতা ও মানবদরদী দৃষ্টিভঙ্গি শরৎচন্দ্রের স্বতন্ত্র কোন সত্তা নয়—তারা যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আলোচ্য গল্পের ঘটনা ও চরিত্র বিশ্লেষণে তা প্রমাণিত। মহেশ’ গল্পে সমকালীন সমাজজীবনের এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তৎকালীন গ্রাম্য সমাজে জমিদারই সর্বেসর্বা। “গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু দাপটে তার প্রজারা টু শব্দটি করিতে পারে না—এমনই প্রতাপ।” জমিদারের স্বার্থচিন্তা ও অর্থলিপ্সা অত্যন্ত প্রবল। তাই গ্রামের গোচারণযোগ্য স্থানটুকু পয়সার লোভে সে জমাবিলি করে দেয়, তার খিড়কীর পুকুরে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। গরীব চাষীর কাহন খানেক বড় বিগত সনের বকেয়া বলে জমিদারের গাদা বন্দী হয়। জমিদারের পাইক পেয়াদারাও গরীব মানুষদের উপর অত্যাচার চালাত। তাই গফুর যখন জমিদারের ডাকে তৎক্ষণাৎ যেতে অস্বীকার করে পেয়াদা তাকে গালমন্দ শুরু করে। তৎকালীন সমাজে একদল মানুষ যে জমিদারের মোসাহেবী করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতে ত্বরান্বিত হত—তাও সমাজসচেতন শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই জমিদারের অত্যাচারী শাসন ছিল তাদের কাছে ‘রাম রাজত্ব। ভণ্ড ধার্মিকতায় ভরা সমাজের বিকৃতি শরৎচন্দ্র নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গোব্রাহ্মণে ভক্তিতে খ্যাত (!) মাণিক ঘোষ তাই মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দেয়। হিন্দু ব্রাহ্মণ তর্করত্ন মহেশের জন্য কাহন খানেক বড় ধার দিতে অস্বীকার করে। ব্রাহ্মণ জমিদার গরীব চাষীদের খড় নিজের গাদাবন্দী করে। হিন্দু সমাজের বর্ণান্ধতাও শরৎচন্দ্রের রচনায় উপেক্ষিত হয়নি। তাই, দিগন্তজোড়া মাঠের পারে, গ্রামের শেষে মুসলমান গফুরের বাড়ী। ব্রাহ্মণের কাছে সে অস্পৃষ্ট। মুসলমান কন্যার সবার সঙ্গে জল ভাগ করে নেওয়ার কোনও অধিকার তার নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাত্র হাতে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যদি কেউ দয়া করে তার পাত্রে জল ঢেলে দেয়, তাই তাকে ঘরে নিয়ে আসতে হবে।

বস্তুতঃ গফুর এখানে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। তাই গফুরের জীবনকে কেন্দ্র করে। বোঝা যায় সে যুগের সাধারণ মানুষের দুরবস্থার কথা। তাদের দুবেলা আহার জুটত না। জমিদারের খাজনায় অতিষ্ঠ হয়ে সুদখোর মহাজনদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না তাদের। সমাজের অত্যাচারে স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে গফুর বাধ্য হয় অনিশ্চিত জীবনপথে পা বাড়াতে। এ গল্পে, শরৎচন্দ্রের মানবদরদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও সুপ্রকাশিত। মহেশের প্রতি পঙ্গুরের অফুরন্ত স্নেহ ও আন্তরিক ভালোবাসাই এই মানসিকতার উৎস। তর্করত্নের কাছে মহেশের জন্য কাহনখানেক খড় ধার চাওয়ার জন্য সে তার অযৌক্তিক অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েছে। “তর্করত্ন কহিল, ‘ধর নিবি, শুষবি কি করে শুনি?’ গফুর আশান্বিত হইয়া ব্যগ্র স্বরে বলিয়া উঠিল, যেমন করে পারি শুধবো বাবাঠাকুর, তোমাকে ফাঁকি দেব না। তর্করত্ন মুখে এক প্রকার শব্দ করিয়া গাফুরের ব্যাকুল কণ্ঠের অনুকরণ করিয়া কহিলেন, “ফাঁকি দেব না। যেমন করে পারি শুধবো। রসিক নাগর!” যখন গফুরকে সে নিরাশ করে চলে যায়, তখন গফুর আর নিজেকে সামলাতে পারে না। মহেশের গলা জড়িয়ে অশ্রু উদ্ধৃত কণ্ঠে সে যখন বলে ওঠে, “ওদের অনেক আছে তবু দেয় না”—তখন তা যেন গম্ভীর ব্যঞ্ছনায় ঝংকৃত হয়ে পাঠক মনকে আচ্ছন্ন করে; এ যেন তৎকালীন সামাজিক অত্যাচারের স্বরূপ উদ্ঘাটক বাক্য বন্ধ। মহেশ দরিদ্র গফুরের কোন কাজে না আসলেও সে কৃতজ্ঞচিত্তে তার পূর্ব উপকারের কথা স্মরণ করে। “মহেশ, তুই আমার ছেলে, তুই আমাদের আটসন প্রিতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস, তোকে আমি পেট পুরে খেতে দিতে পারি নে…কিন্তু, তুই তা জানিস তোকে আমি কত ভালোবাসি।” তারপর সে ঘরের চাল থেকে তখন খড় টেনে মহেশকে দেয় ও আমিনার কাছে ধরা পড়ে যায় এবং নিজের শাকান্ন মহেশকে খেতে দেয় ও উপলক্ষে পিতা-পুত্রীর মধ্যে যে ছলনার অভিনয়টুকু হয়ে যায় তা মানবিকতার প্রাচুর্যে ভরপুর, কারুণ্যের গুণে স্নিগ্ধোজ্জ্বল। মনে হয় অলক্ষ্যে ভগবানও যেন এই মানবতার উদ্বোধনকে অভিনন্দিত করলেন। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ভগবানও যেন এই মানবতার উদ্বোধনকে অভিনন্দিত করলেন। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকটিও হয় সমাজের তথাকথিত ধার্মিকদের কুৎসিত স্বরূপ। এরপর, গফুর কর্তৃক মহেশকে কসাইয়ের নিকট বিক্রয়ের ঘটনায় আপাত অমানবিকতার পরিণামে মনুষ্যত্বেরই জয়গান ঘোষিত হয়েছে। গফুর তার প্রাণপ্রিয় মহেশকে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করতে পারেনি। পরে এক গ্রীষ্ম-দ্বিপ্রহরে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত গফুর যখন জমিদার গৃহে প্রচন্ড মার খেয়ে মুহূর্তের উত্তেজনায় মহেশকে লাঙ্গলের ফলা দিয়ে আঘাত করল—তখনই গল্পের চরম মুহূর্তে উপস্থিত হয়। মনুষ্যত্বের পরাভবে, পাশব, অশুভ শক্তির হলাহল নিপাত যেন পাঠক হৃদয়ে শিহরণের ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। বস্তুতঃ এ-ই তৎকালীন সমাজের রূপচিত্র। গফুর, মহেশ কেবল প্রতীক মাত্র। মানবতার এই নিদারুণ পরাভবই ছিল যে যুগের সমাজের বৈশিষ্ট্য। সমাজের অত্যাচারের স্বাভাবিক জীবনপথ ছেড়ে গফুর যাত্রা করে অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে, ফুলবেড়ের চটকলের সম্ভ্রমহীন, অনিশ্চিত জীবনযাপনের পথে। পিছনে ফেলে জল খাবার ঘটি; ভাত খাবার পিতলের থালা-মহেশের হত্যার প্রায়শ্চিত্তের জন্য। গল্পের শেষে নিজ দোষ স্বীকারের পর গফুর যে আর্তকণ্ঠে আল্লার কাছে বিচারের প্রার্থনা জানায় তার কণ্ঠে যে চাপা বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়—তাতে লেখকের এই ইচ্ছাই ব্যক্ত হয়েছে যে জগতের চির নিপীড়িত গফুরেরা ঐশ্বরিক শক্তির সহায়তায় অত্যাচারীর হাত থেকে নিজেদের প্রাপ্য আদায় করে নেবে। এইভাবে মনুষ্যত্বের পরাজয়ের পরেও মনুষ্যত্বের আশু জয়লাভের সম্ভাবনার মন্ত্র উচ্চারণ করে মানবদরদী শরৎচন্দ্র পাঠককেও মানবতাবোধে উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন ‘মহেশ’ গল্পে।

 

৫। ‘মহেশ’ গল্পটি অবলম্বন করে গফুরের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো। 

 

উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে মহেশ একটি ষাঁড়ের নাম। বস্তুত এই মহেশকেই কেন্দ্র করে কাহিনির সূচনা, ব্যাপ্তি ও সমাপ্তি। আর সেই সূচনা-প্রসার সমাপ্তি মহেশের প্রতিপালক গফুরের চিন্তাভাবনা, আনন্দ, দুঃখ-বেদনার পটভূমিতেই বর্ণিত হয়েছে। কাজেই বোঝা যায় যে এই গল্পে ‘মহেশ’ নামকরণের অন্তরালে গফুরই মূলতঃ কাহিনি-স্রোতকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। গফুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই এর সত্যতা উপলব্ধি করা সম্ভব। মহেশ নামক ষাঁড়টি গফুরের কাছে ছেলের মত। আট বছর সে তাদের প্রতিপালন করে বুড়ো হয়েছে। কিন্তু গফুর অকৃতজ্ঞা নয়; নিজ দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অসচেতনও সে নয়। তাই, মহেশের উপকার সে ভোলে না। বস্তুতঃ গফুর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই বলা যায় মহেশের প্রতি তার অফুরন্ত স্নেহ যা তার একমাত্র কন্যা আমিনার প্রতি স্নেহের চেয়েও সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে বড় হয়ে উঠেছে। মহেশের জন্য জমিদার বাড়ী প্রত্যাগত তর্করত্নের পাষণ্ড, ম্লেচ্ছ সম্বোধন সে তুচ্ছ করেছে। তর্করত্ন যখন তাকে অভিযুক্ত করে বলে, “তাও নেই বুঝি? কি করলি খড়? ভাগে এবার যা পেলি সমস্ত বেচে পেটায় নম? ব্যাটা কসাই।” এই অযৌক্তিক নিষ্ঠুর অভিযোগে বাকরোধ হয়ে যায় গফুরের। মহেশকে খাওয়ানোর জন্য জমিদারের কাছে পন-দশেক বিচুলি চেয়ে সে প্রত্যাখ্যাত হয়। একইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় তর্করত্নের কাছে কাহন দুই খড় ধার চেয়ে। তারপর, সে সজল নয়নে মহেশের ক্ষুধার্ত গভীর কালো চোখের পানে চেয়ে তার অক্ষমতার কথা, অকৃতজ্ঞতার কথা বলে। অতঃপর, পড়ো পড়ো দেওয়ালের মাথার চাল থেকে খড় টেনে মহেশকে খেতে দেয়; জ্বরের অজুহাতে নিজের শাকান্ন মহেশকে খাওয়ায়। মাণিক ঘোষেরা মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দিলে পিতলের একমাত্র বন্ধক দিয়ে একটি টাকা সংগ্রহ করে মহেশকে ফিরিয়ে আনে। মহেশহেতু ক্ষতির জন্য ভ্রান্তিবশতঃ সে কসাইকে ডেকে আনে, পরে মনোভাব পরিবর্তিত হলে জমিদারের দোহাই দিয়ে তাদের বিতাড়িত করে। একথা জমিদারের কানে গেলে সে স্বেচ্ছায় নাকে খত দেয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে গফুর সবরকমের শাস্তি মাথায় পেতে নিতে পারে; কিন্তু মহেশ অভুক্ত থাকলে বা তার ক্ষতি হলে নিজেকে সে সামলাতে পারে না। বস্তুতঃ মহেশ ও গফুর উভয়ের পরিপূরক। এক চরিত্রের পূর্ণতার জন্য অপর চরিত্র অপরিহার্য। কিন্তু এক কর্মহীন দ্বিপ্রহরে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত গফুর কিছু না খেতে পেয়ে বকাবকি করে আমিনাকে জল আনতে পাঠায়। এদিকে, মহেশ জমিদারের বাগান নষ্ট করায় গফুরকে নিতে যেতে পাইক আসে। আত্মবিস্মৃত গফুর জমিদারদের নামে কটূক্তি করে পরে বলে, “মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারো গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি। আমি যাবো না।” পরে প্রচন্ড প্রহার সহ্য করতে হয়েছে তাকে। এদিকে কলসী কাখে আমিনার গৃহে প্রবেশের মুহূর্তে মহেশ তাকে গুঁতিয়ে ফেলে দিয়ে ঘট থেকে ঝরে পড়া জল শুষে খেতে থাকে। ক্রোধার গফুরের লাঙলের ফলার আঘাতে মহেশের মৃত্যু হয়। আত্মবিস্মৃত গফুর আত্মসংবরণ শেষে শোকে পাথর হয়ে যায়। মুচির দল মহেশকে নিয়ে যেতে আসে। তাদের হাতে চকচকে ছুরি দেখে শিউরে ওঠে গফুর। মহেশের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে আমিনার হাত ধরে রাতের আঁধারে গফুর যাত্রা করে। সম্ভ্রমহীন ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে। জাতে মুসলমান হলেও, দরিদ্র হলেও গফুর মানবিকতাবোধে তর্করত্ন বা ব্রাহ্মণ জমিদারের অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ। নিজের পাপ সে অস্বীকার করেনি। সেজন্য সে প্রাপ্য শাস্তি প্রার্থনা করেছে। প্রার্থনা করেছে তাদেরও শাস্তি যারা মহেশকে মাঠের ঘাস, তেষ্টার জল খেতে দেয়নি। “আল্লা। আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ করো না। এ গল্পে মহেশের মৃত্যু অপ্রত্যাশিত নয়। কঠোর সমাজ, দারিদ্র্যা, মহেশের ক্ষয়ক্ষতি দৈহিক দুর্বলতা গফুরকে করে তুলেছে একাস্ত স্নেহপাত্রের হত্যাকারী। এ গল্পে লেখক দেখাতে চেয়েছেন, সমকালীন জমিদারের অপশাসন, উঁচু অর্থকৌলীন্যযুক্ত মানুষের অমানবিকতা, তারই মধ্যে হতদরিদ্র এক চাষীর অতুলনীয় মানবিকতাবোধ। গফুর এখানে অত্যাচারিত, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি। জগতে চিরদিন গফুরেরা কিভাবে উঁচু স্তরের মানুষের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে সাধারণ জীবন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়ে অনিশ্চিত জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়, প্রাপ্য থেকে বর্ণিত হয়—সে চিত্রই লেখক আঁকতে চেয়েছেন। গল্পের শেষাংশে গফুরের কণ্ঠে যে চাপা বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে তা লেখকের আশাবাদী মনের পরিচারক। জগতে পদদলিত জাতি বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের প্রাপ্য আদায় করবে এটাই লেখকের আশা। মহেশকে কেন্দ্র করে গফুরের জীবন-কথার আধারে করুণ রসসিক্ত পথে লেখকের এই উদ্দেশ্যগুলি পাঠকের সামনে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ওঠায় বলা যায় ‘মহেশ’ গল্পে গফুরই প্রধান চরিত্র।

৬। ‘মহেশ’ গল্পটি অবলম্বনে তর্করত্ন ও আমিনার চরিত্র দুটি বিশ্লেষণ করো।

 

উত্তর : তর্করত্ন : মহেশ শরৎচন্দ্রের সমাজসচেতনতা ও মানবদরদী দৃষ্টিভঙ্গীর এক অনবদ্য সৃষ্টি। মহেশ নামের একটি ষাঁড়ের উপর মুসলমান গফুরের স্নেহ, ভালবাসা, মমতাকে কেন্দ্র করে সমকালীন সমাজের তথাকথিত উচ্চ ও ধার্মিক শ্রেণির নীচতা, বিকৃতি, অবক্ষয় ও ভণ্ডামির পূর্ণ প্রকাশই আলোচ্য গল্পের উপজীব্য। তর্করত্ন চরিত্রটি এই সামাজিক অবক্ষয়েরই একজন ধারক এবং গল্পের উদ্দেশ্য পরিপূরণে অপরিহার্য। গল্পের প্রারম্ভেই আমরা তর্করত্নের উপস্থিতি লক্ষ্য করি। তর্করত্ন দ্বিপ্রহরে জমিদার গৃহে ছোট ছেলের জন্মতিথি উপলক্ষে পুজো সেরে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে গফুরের বাড়ীর সামনে ঠায় রৌদ্রে বাঁধা মহেশকে দেখতে পান; হঠাৎই যেন তাঁর গোভক্তি বেড়ে যায়। পাষণ্ড, ম্লেচ্ছ সম্বোধনে গফুরকে পর্যুদস্ত করে ডেকে এই নিরীহ পশুটিকে অহেতুক কষ্ট দেওয়ার জন্য তিরস্কার আরম্ভ করেন। তার ঢ় অযৌক্তিক আচরণে বাকরোধ হয়ে যায় গফুরের। কিন্তু এরপর গফুর যখন কাহন খানেক খড় ধার চায় তখন তা মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করেন তর্করত্ন। গফুরের আন্তরিক কাকুতি মিনতি তার কাছে পরিহাসের বিষয়—“ইস! সাধ করে আবার নাম রাখা হয়েছে মহেশ। হেসে বাঁচিনে।” পরে খড় শোধ করে দেবার ব্যাপারে গফুরের ব্যাকুল কণ্ঠের অনুকরণে তিনি বলেন, “ফাঁকি দেব না। যেমন করে পারি শুধবো। রসিক নাগর।” তর্করত্ন অমানুষ। অত্যাচারী জমিদারের শাসনকে তিনি ‘রামরাজত্ব’ বলে বর্ণনা করেন। অস্পৃশ্যতা দোষে দুষ্ট তৎকালীন উচ্চবর্ণের মানুষের প্রতিনিধি তর্করত্ন। গফুর ব্রাহ্মণের পায়ের কাছে বসে পড়লে, তিরবৎ দুপা পিছিয়ে গিয়ে তিনি বলে ওঠেন, “আ মর। ছুঁয়ে ফেলবি নাকি?” ক্ষুধার্ত মহেশকে খাওয়ানোর জন্য গফুরকে কাহন খানেক খড় ধার দেওয়ার ব্যাপারে তর্করত্নের অস্বীকৃতি তাঁর ধর্মীর ভন্ডামির পরিচায়ক। তর্করত্নের অমানবিকতার স্বরূপ আমরা উপলব্ধি করি তখন, যখন প্রত্যাখাত গফুর সজলনেত্রে মহেশের গলা জড়িয়ে ধরে আক্ষেপের সুরে বলে ওদের অনেক আছে তবু দেয় না। এরপর তর্করত্নের এ গল্পে আর একবার উপস্থিত হয়ে ‘গো’ শব্দের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দিতে শুনি। তিনি ধর্মজ্ঞানহীন ম্লেচ্ছজাতিকে গ্রামের ত্রিসীমানায় বসবাস করতে দেওয়া নিষিদ্ধ—একথা প্রকাশ করে সকলের জ্ঞাননেত্র উন্মোচিত করেন। অথচ তাঁর কাজ তাঁর কথার পরিপন্থী। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অমানবিকতা, ভণ্ডামির চূড়ান্ত নিদর্শন ব্রাক্ষ্মণ তর্করত্ন।

 

আমিনা :

মহেশ’ গল্পে গফুর ও মহেশকে কেন্দ্র করে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রোদ্ঘাটনের একান্ত সহায়ক মাতৃহারা গফুরের বালিকা কন্যা আমিনার চরিত্র। আমিনাই একমাত্র গফুর ও মহেশের আনন্দ-বেদনার সাক্ষী, সুখ-দুঃখের সাথী। শান্ত বালিকা আমিনা গহ্বরের ঘর-সংসার সামলায় গফুরের মতই মহেশের প্রতি তার স্নেহ অফুরন্ত। ঘর-সংসারের দিকে তার সজাগ দৃষ্টি। তাই, গফুর যখন চালা থেকে খড় টেনে মহেশকে খাওয়ায় অথবা নিজে না খেয়ে মহেশকে নিজের শাকান্ন খাওয়ানোর জন্য শরীর খারাপের অভিনয় করে—তা আমিনার চোখ এড়ায় না। আবার, সে বিষয়ে তার নীরব প্রশ্রয়দানে মহেশের প্রতি তার দরদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গফুরের ছন্নছাড়া ঘরে আমিনার ভূমিকা যেন পরিত্রাতার; সবকিছু সামলানোই তার দায়। তাই, ঘরে ভাত বা তৃয়ার জল না থাকলে সে নীরবে পিতার প্রহার ও তিরস্কার সহ্য করে। বিনা প্রতিবাদে পরবর্তী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। অবশ্য গফুরও পরে বুঝতে পারে যে মাতৃহারা কন্যাটির দোষ কিছুই নেই। ক্ষেতের সামান্য ধান কয়টি ফুরানোমাত্র তাদের পেটপুরে দুবেলা আহার জোটে না সেক্ষেত্রে দিনে পাঁচ ছ’বার ভাত খাওয়া যেমন অসম্ভব তেমনি মিথ্যা। আর, প্রচণ্ড গ্রীষ্মে পুকুর শুকিয়ে গেলে জলাশয়ের মাঝখানে গর্ত খুঁড়ে যে জল ওঠে তা নিয়ে চলে কাড়াকাড়ি। মুসলমান মেয়েটির সে জলে ভাগ বসানো অধিকার নেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা একপাশে দাঁড়িয়ে থাকার পর কেউ যদি দয়া করে তার পাত্রে জল ঢেলে দেয় তবে তাই সে ঘরে আনে। গফুর ও মহেশকে কেন্দ্র করে আমিনার জগৎ ক্ষুদ্র। তাই গো-হাটা শব্দের অর্থ তার কাছে অপরিজ্ঞাত। গফুর যখন ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করার জন্য যাত্রা করে তখন সে আশ্চর্য হয়ে যায়; বহু পরিচিত পিতার মনোগত সম্বন্ধে কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। কারণ পিতার কাছেই সে শুনেছে সেখানে ধর্ম থাকে না, মেয়েদের ইজ্জত আৰু কিছু থাকে না। গৃহকর্মে নিপুণা আমিনার গৃহপ্রব্যের উপর টান স্বাভাবিক। তাই চিরবিদায়ের প্রাক্কালে জলখাবার ঘটি ও পিতলের ভাত খাবার থালা সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। পিতার প্রহার বা তিরস্কারে সে কাঁদেনি, কিন্তু মহেশের নির্মম মৃত্যু দৃশ্যে সে চীৎকার করে কেঁদে ওঠে, বলে, “কি করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *