পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

আজকের আমাদের বিষয় হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে , পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল এর প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেয়া হলো ।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ | পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব | পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল | পলাশীর যুদ্ধের কারণ | পলাশীর যুদ্ধ ১৭৫৭

পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

 

পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) কারণ

 

উত্তর: অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে রাজনৈতিক শক্তি স্থাপনের দিকে মনোযোগী হয় এবং দাক্ষিণাত্যের পর বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর যুদ্ধ এই প্রচেষ্টার অনিবার্য পরিণতি বলা যায়।

যুদ্ধের দ্বৈত কারণ:

 

পলাশী যুদ্ধের কারণগুলি ছিল দু’প্রকারের। যথা- একদিকে বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক অনিশ্চিত ও ষড়যন্ত্রমূলক পরিবেশ রচিত হয়েছিল এবং অন্যদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাবের সার্বভৌম ক্ষমতা খর্ব করে নিজেদের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিল। ফলে নবাব। সিরাজদৌল্লার সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিবাদ শুরু হয়।।

সিরাজ-ইংরেজ দ্বন্দ্ব:

 

সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদের কারণগুলি ছিল: (১) সিরাজ সিংহাসনে বসার পর ইংরেজরা প্রচলিত নিয়ম মেনে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি।

(২) বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়েও ইংরেজরা প্রতিশ্রুত শর্ত লঙ্ঘন করে দস্তকের অপব্যবহার করে নবাবকে শুল্ক ফাঁকি দিতে শুরু করে।

(৩) সিরাজের সিংহাসন লাভকে কেন্দ্র করে আলিবর্দি খাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসেটি বেগম ও মধ্যম কন্যার সন্তান পূর্ণিয়ার নবাব সওকং জঙ্গ সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ঘসেটি বেগমের প্রধান সমর্থক রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে ইংরেজরা কলকাতায় আশ্রয় দান করে। সিরাজ ইংরেজদের কাছে কৃষ্ণদাসকে প্রত্যর্পণের দাবী করেন। কিন্তু ইংরেজরা কৃষ্ণদাসকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে।

(8) সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে এবং ওটির নির্মাণ বন্ধ করার নবাবী নির্দেশ অমান্য করে। এভাবে ইংরেজরা সুপরিকল্পিতভাবে সিরাজের সার্বভৌম ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ শুরু করে। ফলস্বরূপ সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।

সিরাজের নমনীয়তা:

 

এই চরম দুঃসময়ে সিরাজ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেন নি। ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর হস্তে দমন না করে তিনি তাঁদের নিকট অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। সব ব্যবস্থা প্রস্তুত হলে ইংরেজরা রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে সিরাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ অভিযোগ করেন যে, সিরাজ আলিনগরের সন্ধির কিছু শর্ত লঙ্ঘন করেছেন। এটি অবশ্য সত্য ছিল না। ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের পথে কোথাও বিশেষ বাধা পেলেন না যদিও বহু স্থানেই নবাবের কর্মচারী ছিল।

কলকাতা দখল:

 

সিরাজ প্রথমেই কৌশলে, কোনও প্রকার রক্তপাত না ঘটিয়ে ঘসেটি বেগমকে নিজ প্রাসাদে অবরুদ্ধ করেন। এরপর ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করতে বারংবার অস্বীকার করায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে সসৈন্যে যুদ্ধ যাত্রা করেন। কাশিমবাজার কুঠি দখল করে তিনি কলকাতা আক্রমণ করেন। গভর্ণর ড্রেক ও পদস্থ ইংরেজরা পালিয়ে যায়।

আলিনগরের সন্ধি:

 

কলকাতা পতনের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছলে মাদ্রাজের দৃঢ়চিত্ত গভর্ণর সান্ডার্স কর্ণেল ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে সৈন্য নিয়ে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু সামান্য যুদ্ধ বিগ্রহের পর কয়েকদিনের মধ্যে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সমস্ত রকম সুবিধা লাভ করে, এমনকি বিনা শুল্কে বাণিজ্য পরিচালনা ও দুর্গ নির্মাণের অধিকারও লাভ করে।

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব:

 

চন্দননগরের ফরাসীদের সঙ্গে নবাবের সম্ভাব্য ইংরেজ-বিরোধী জোট গঠনের পথ রুদ্ধ করার জন্য ইউরোপের সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সুত্র ধরে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করেন। নবাবের নিষেধের পরোয়া না করে তিনি চন্দননগর দখল করেন। ফলে বিতাড়িত ফরাসীরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় গ্রহণ করে। অতঃপর ক্লাইভ মীরজাফরকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদের রাজদরবারে সিরাজ বিরোধী যে ষড়যন্ত্রের চক্র গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে যোগদান করেন। দেশের স্বার্থান্বেষীদের এই ষড়যন্ত্রে আরও ইন্ধন যোগানের জন্য ক্লাইভ সমস্ত রকমের নীচতা, হীনতা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেন নি। অবশেষে সিরাজকে মসনদচ্যুত করে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর জন্য ক্লাইভ মীরজাফরের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন। এর পরিণতি রূপেই পলাশীর যুদ্ধের সূচনা হয়।

পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব / পলাশী যুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

 

পলাশী যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন। পলাশীর যুদ্ধের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া পলাশী যুদ্ধের পরোক্ষ গুরুত্ব রয়েছে কারণ পলাশীর যুদ্ধের ফলেই ইংরেজ তথা ব্রিটিশ শক্তি বাংলায় তাদের আধিপত্য সুদৃঢ় করেছিল।

(স্যার জে. এন, সরকার বলেন যে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন ভারতে মধ্যযুগের অবসান হয় এবং আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে। Admiral Waton ও বলেন পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব কেবলমাত্র কোম্পানীর ক্ষেত্রেই নয় ব্রিটিশদের আধিপত্যের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব ছিল। কোম্পানীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভারতীয়দের তারা পরাজিত করেছিলেন অল্প সেনাবাহিনীর সাহায্যে। এই পলাশীর বিজয় থেকেই ভারতে ব্রিটিশদের বিজয়ের সূচনা ঘটেছিল। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল ষড়যন্ত্রের সাহায্যে ব্রিটিশদের এই বিজয়ের ফলে তাদের মনে হয়েছিল বেশ কিছু মীরজাফর ও জগৎ শেঠ রয়েছে যারা ভারতীয় শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করতে ইংরেজদের সাহায্যে করবে পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব এখানেই যে, সিরাজদ্দৌলার মৃত্যুর পর ইংরেজরা নতুন নবাব মীরজাফরকে ‘পুতুল নবাব’ হিসাবে সিংহাসনে বসায়। সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতাই ইংরেজদের হাতে ছিল।

পলাশীর যুদ্ধের অর্থনৈতিক গুরুত্বও ছিল। কোম্পানী বাংলার বাণিজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। পলাশীর যুদ্ধের ফলে কোম্পানী আর্থিক দিক থেকেও লাভবান হয়েছিল। সম্পদের বহির্গমন ঘটেছিল। বাংলার প্রচুর সম্পদ আত্মসাৎ করে ইংরেজরা দক্ষিণের যুদ্ধে এবং উত্তর ভারতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কোম্পানী তো পলাশীর যুদ্ধে লাভবান হয়েছিলই ইংরেজ কর্মচারীরাও প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের ফলে ভারতীয়দের সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ইংরেজরা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ফরাসী, মারাঠা এবং শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ইংরেজ শক্তির আত্মবিশ্বাস বিশেষভাবেই পরবর্তীকালে তাদের সাফল্য এনে দিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধ কেবলমাত্র বড় যুদ্ধের “মহড়া” ছিল না পলাশীর যুদ্ধ ছিল ইংরেজ আধিপত্য লাভের প্রথম ‘সোপান’ যা তারা সহজেই অর্জন করতে পেরেছিল। পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব এখানেই যে পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ আধিপত্য সূচনা ঘটে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *