রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪

প্রিয় ছাত্রছাত্রী আজকে আমি তোমাদের সামনে Burdwan University এর সেম ২ বাংলা রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ নিয়ে হাজির হয়েছি এখানে তোমরা রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ এখানে সব কিছুই সহজ ভাষায় বুঝতে পারবে । রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ এর মধ্যে রয়েছে সংক্ষিপ্ত , রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর । রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ এর সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর আছে ২০ টা আর রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ রচনাধর্মি প্রশ্ন ও উত্তর আছে ৮ তার মতো যেগুলো খুব সহজ ভাষায় আছে । তোমরা রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ পড়ে দেখ নিশ্চই কমন ও পড়তে ভালো লাগবে ।

রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর |রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪| রসময়ীর রসিকতা’ গল্প (প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়) | SEM 2 | BURDWAN UNIVERSITY

 

১। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পটি কত সালে কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

উঃ গল্পটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৩১৬ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়।

২। রসময়ীর রসিকতা গল্পটি কোন্ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত?

উঃ গল্পটি ‘গল্পাগুলি’ (১৯১৩) গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত।

৩। রসময়ীর রসিকতা গল্পটি কোন ধরনের গল্প?

উঃ গল্পটি কৌতুক রসাসৃত আদ্যস্ত হাস্যরসাত্মক গল্প।

উ: গল্পটিতে আটটি পরিচ্ছেদ আছে।

৫। রসময়ীর রসিকতা গল্পটির শেষ লাইনটি উল্লেখ করো।

উ: গল্পটির শেষ লাইনটি হল – “ ক্ষেত্রমোহন বলিলেন— “ঠাকুরঝি, এসব কী?”—ঠাকুরঝি আপন মনে মালা জপ করিয়া যাইতে লাগিলেন।”

৬। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পের ‘রসময়ী” কে? তার এরকম নামের কারণ কী?

উ: রসময়ী হলেন ক্ষেত্রমোহন বাবুর স্ত্রী। যিনি গল্পের নায়িকা। এরকম নামের কারণ হল- যার মধ্যে অনেক রস বর্তমান থাকে। এক্ষেত্রে গল্পকার বলেছেন- ..তবে, রসও অনেকগুলি আছে কিনা—এ ক্ষেত্রে রৌদ্ররস।

৭। ক্ষেত্রমোহন কে? তার বাড়ি কোথায় ?

উঃ ক্ষেত্রমোহনবাবু জেলা কোর্টের প্রখ্যাত মোক্তার। তাঁর আদিবাড়ি হুগলিতে ছিল না। পয়সা উপার্জনের জন্য হুগলিতেই বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন।

৮। রসময়ীর পিত্রালয় কোথায়? তার কয়টি সন্তান ?

উ: রসময়ীর পিত্রালয় হালিশহরের চৌধুরী পাড়ায়। তিনি নিঃসন্তান।

৯। রসময়ীর পিত্রালয়ে কে কে আছেন?

উ: পিতা-মাতার অনেক দিন মৃত্যু হয়েছে। এখন সে বাড়িতে রসময়ীর বিধবা দিদি বিনোদিনী এবং তার দুটি ছোটো ভাই নবীন ও সুবোধ বাস করে।

১০। ক্ষেত্রমোহন বাবু দ্বিতীয়বার কাকে বিয়ে করতে যান?

উ: চুঁচুড়ার হরিশ চাটুজ্জো, যিনি জজ আদালতে কাজ করেন। তাঁর তেরো বছরের মেয়েকে।

১১। রসময়ীর মৃত্যুর পর তাঁর মুখাগ্নি করে কে?

উঃ রসময়ী নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর স্বামী ক্ষেত্রমোহন বাবু মুখাগ্নি করেছিলেন।

১২। রসময়ীর মৃত্যুর কতদিন পর ক্ষেত্রমোহনবাবু কাকে বিয়ে করার জন্য মনস্থির করেন?

উ: রসময়ীর মৃত্যুর ছ’মাস পর ক্ষেত্রমোহন নিজে হুগলির ইংরেজি জানা রজনীকান্ত ঘোষালের মেয়েকে দেখে পছন্দ করেন।

১৩। “বরের খুড়া মহাশয় গ্রাম হইতে আসিয়াছেন—কল্য আশীর্ব্বাদ”-কোন গল্পের অংশ? কার সঙ্গে আশীর্বাদ? শেষ পর্যন্ত কি আশীর্বাদ হয়েছিল?

উঃ উক্ত চরণটি রসময়ীর রসিকতা গল্পের অংশ। ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গ্যে রজনীকান্ত ঘোষালের মেয়ের আশীর্বাদের কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ হয়নি। কারণ তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও বেগুনি রঙের ম্যাজেন্টা কালি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে লেখা – “… বিবাহ করিও না করিলে তোমার নলাটে অসেস দুগগতি লেখা আছে।—রসমই।”

১৪। শেষ পর্যন্ত ক্ষেত্রমোহন বাবুর কি বিয়ে হয়েছিল ?
 
উঃ না। খুড়ার যুক্তিতে শেষ পর্যন্ত রসময়ীর মৃত্যুর একবছর পূর্ণ হলে গয়ায় পিণ্ড দিয়ে এসে বিয়ে স্থির করল।

১৫। এই গল্পে রসময়ী ক্ষেত্রমোহনকে ক-টি পত্র দিয়েছিল? পত্রগুলির মূল বক্তব্য কী?

উঃ রসময়ী সাক্ষরিত ক্ষেত্রমোহনকে তিনটি পত্র দিয়েছিল। চিঠিগুলির মূল বক্তব্য হল – রসময়ী মরে গিয়েও বেঁচে আছে তাই ক্ষেত্রমোহন যাতে কোনভাবেই বিবাহ না করে। আর যদি করে তাহলে ক্ষেত্রমোহনের কপালে অনেক দুর্গতি আছে।

১৬। ক্ষেত্রমোহনের শ্যালিকার নাম কী? তিনি কোথায় থাকতেন ?

উঃ ক্ষেত্রমোহনবাবুর শ্যালিকা বিধবা – বিনোদিনী। তিনি তাঁর বাপেরবাড়ি হালিশহরে থাকতেন।

১৭। গল্পে উল্লেখিত ক্ষেত্রমোহনবাবুর বয়স কত? এবং তাদের দাম্পত্য জীবন কত বছরের?

উঃ ক্ষেত্রমোহনের বয়স এখন চল্লিশ বছর। আর স্ত্রী রসময়ীর বয়স এখন ত্রিশ বছর। তাদের দাম্পত্যজীবন কেটেছে আঠারো বছর।

১৮। ক্ষেত্রমোহন কেন দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে চেয়েছিলেন?

উঃ ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ীর আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবন কেটেছে শুধু ঝগড়া আর সন্ধি করে। তাছাড়াও এই আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবনে রসময়ী কোনও সন্তান দিতে পারেনি। সেই সন্তানের আশায় তিনি পুনরায় বিবাহ করতে চেয়েছিলেন।

১৯। “হামি টোমার সার্চ খড়িবে।”—কে, বলছে? কার শ্বশুরবাড়ি সার্চ করবে? কেন সার্চ করবে?

উ: পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ক্ষেত্রমোহনবাবুর হালিশহরের শ্বশুরবাড়ি মার্চ করবেন পুলিশের কাছে খবর ছিল এই বাড়িতে বোমা তৈরী হয়। সেটা সত্যি কিনা দেখার জন্যই পুলিশ সার্চ করতে চেয়েছেন।

২০। পুলিশ খানা তল্লাশি করে কী কী পেল?

উ: পুলিশ খানা-তল্লাশি করে কিছু পাঁজা, কাশীদাসী মহাভারত এবং একখানা বটতলার ছেঁড়া উপন্যাস, খানকতক পুরাতন দলিল আর বিনোদিনীর বাক্স থেকে বের হল এক বান্ডিল চিঠি এবং খান কতক ঠিকানা লেখা সাদা খাম।

রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪

রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর |রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ | রসময়ীর রসিকতা’ গল্প (প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়) | রসময়ীর রসিকতা’ গল্প (প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়) | SEM 2 | BURDWAN UNIVERSITY

 

1. রসময়ীর রসিকতা গল্পে যে দাম্পত্য জীবনের ছবি পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

 

উত্তর। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পের শুরুই হয়েছে ক্ষেত্রমোহন বাবুর আঠারো বছরের দাম্পত্যজীবন কেমন করে কেটেছে তার বর্ণনা দিয়ে। আঠারো বছর তাদের বিবাহ হয়েছে, কিন্তু কোনো সন্তান নেই। এই সন্তান না থাকাটাই তাদের দাম্পত্য জীবনকে বিড়ম্বনাপূর্ণ করে তুলেছে। সন্তানের অভাব হেতু মানসিক ঘাত-প্রতিঘাত রসময়ীর মনকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছে। এই বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু স্বামীর প্রতি তার আস্থা হীনতা। যে স্বামী তাকে সন্তান সুখে সুখী করতে পারেনি, সেই স্বামীকে সুখ প্রদানে তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার বিকৃত মানসিকতা। একসময় সন্তানের আশা সে ছেড়েই দিয়েছে। কিন্তু একটা ভয় ক্রমশ জগদ্দল পাথরের। মতো চেপে বসেছে। তিনি ভাবতেন, সন্তানহীনতার জন্য তাকে দায়ী করে স্বামী পাছে আবার বিবাহ করে। সে ভয়েই সে কাতর।

স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে সে ক্ষেত্রমোহনকে বাড়িছাড়া করেছে। নিজে যায় হালিশহরে পিত্রালয়ে। বাড়ি ফিরে এসে বসবাস করার মধ্যে প্রতিজ্ঞা করেন স্ত্রীর মুখদর্শন তিনি কোনও ক্রমেই করবেন না। অন্য জায়গায় বিবাহ করবেন। এদিকে মাসাধিক কাল হয়ে যাওয়ায়, ক্ষেত্রমোহন রসময়ীকে আনতে না যাওয়ায় রসময়ী চিন্তিত হয়ে পড়ল। উপরন্তু গুজব রটল ক্ষেত্রবাবুর অন্যত্র বিবাহ পাকাপাকি স্থির, এই খবর সে হুগলি ব্রাঞ্জ স্কুলের একটি ছাত্রের কাছে শুনেছেন। দিদি বিনোদিনী ছেলেটিকে ডাকিয়ে এনে সব তথ্য সংগ্রহ করে ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে চুঁচুড়ার হরিশচন্দ্র চাটুজ্জের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে ক্ষেত্রমোহন-এর বলা কথাগুলো শুনে অসম্ভব ক্ষিপ্ত হয়ে রসময়ী, চিৎকার, গালাগালি, মারধর ও শেষে এক কদর্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পুলিশ এসে পৌঁছালে খিড়কি দরজা দিয়ে তারা পালিয়ে যায়।

একদিন কাছাড়ি বাড়িতে রসময়ী এসে উপস্থিত হয়, উভয়ের মধ্যে তীব্র ক্রোধ, শ্লেষাত্মক সংলাপ। বিনিময়ের পর সমগ্রী তার স্বামী আবার বিবাহ করলে কী বিধান দেবে ফিরিস্তি দেয়। এর উত্তরে ক্ষেত্রমোহন বলে—“তুমি না মরলে আর বিয়ে করছি নে, মরবে কবে?” রসময়ী বিদ্রুপের স্বরে হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, “রসি বামনি এমনি মরছে না। তার এখনও অনেক দেরি-বিস্তর বিলম্ব।” রসময়ীর পক্ষে যুক্তি হল স্বামী একেবারে সম্পূর্ণ অক্ষম বৃদ্ধ হয়ে গেলে কোনও মেয়ে যখন তাকে বিয়ে করতে রাজি হবেনা, তখনি মরবে।

 

আরোও পড়ুন ‘ প্রফেসর শঙ্কুর ডায়েরি- কর্ভাস গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪

কিন্তু এইসব কথার পর ছমাস কেটে গেলে ত্রুটিহীন চিকিৎসার পরেই রসময়ীর মৃত্যু ঘটে। যে দাম্পত্যজীবনে এত ঝগড়াকাটি, গালমন্দ, সে দাম্পত্যেই ক্ষেত্রমোহনের চোখ দিয়েই ভুল পড়ে। ফলে দুটি চরিত্রই তাদের কেন্দ্র থেকে সরে যায়নি, তাদের দাম্পত্য জীবনে স্নিগ্ধ বাতাস হয়তো ছিল না কিন্তু মরুদ্যানের নির্জনতায় আপন অস্তিত্ব বজায় ছিল।

 

2.রসময়ীর রসিকতা গল্পে বিনোদিনী চরিত্রের গুরুত্ব আলোচনা করো ।

উত্তর। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যে যুগে গল্প লিখছেন সে যুগে নারীর অধিকারহীনতাই স্বাভাবিক ছিল। পুরুষশাসিত সমাজে অধিকারহীনা নারীর যে-কোনও প্রকারের অধিকার প্রয়োগের ঘটনা সমাজে নিন্দনীয় ছিল। পুরুষের কামনা ছিল মনোবৃত্তির অনুগামিনী স্ত্রী। নারীর অবস্থান সম্পর্কে বলা হত—নারী বালো পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয়েছে।এই ভাবনা থেকে প্রভাতকুমার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। বিনোদিনী চরিত্রটি তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই গল্পের দুটি নারী চরিত্রের প্রকাশ দেখা যায়। একটি গল্পের নায়িকা রসময়ী অপরটি তারই বোন বিনোদিনী। অসমরী এই গল্পের একজন দজ্জাল মহিলা হিসেবেই পরিচিত তবে, এই দজ্জালকে বারবার উস্কে দিয়েছে তারই বোন বিনোদিনী। কেননা বিনোদিনী সেই ইস্কুলের ছেলেটিকে খোঁজ করে ডেকে নিয়ে এসেছে এবং ছেলেটিকে সন্ধ্যে নিয়ে বিনোদিনী রসমগ্রীকে নিয়ে গেছে চুঁচুড়ার হরিশ চাটুজ্জ্যের বাড়ির অন্দরমহলে। সেখানে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পুলিশ এসে পৌঁছালে বিনোদিনীর যুক্তি মেনেই রসমরী খিড়কি দরজা দিয়ে বাইরে এসে নিজেদের গাড়িতে চেপে পালিয়ে মুক্তি পায়।এই গল্পের মূল চাবিকাঠি তিনটি চিঠি। যা রসময়ীর মৃত্যুর পর একে একে পরলোক থেকে স্বামী ক্ষেত্রমোহনের কাছে এসে পৌঁছায় ও ঘটনার প্লটের বাঁধুনি শক্ত হয়—এই চিঠিগুলি সবই তো বিনোদিনীর পাঠানো। তাই এখানে বিনোদিনীর গুরুত্বই সর্বাধিক। রসময়ীর মৃত্যুর পরও রসময়ীর বেঁচে থাকা এবং মৃত্যুর পরে যাবতীয় প্রকাশ্য ও গোপন কর্মকান্ডের একমাত্র চালিকাশক্তি বিনোদিনী। সমগ্র গল্পটির ছক আড়ালের কলাকৌশল সবই বিনোদিনীর হাতে ও বুদ্ধিতে ধরা আছে। বিনোদিনী ধীর, স্থিত, সংযত শাস্ত মূর্তি, এতকিছুর মধ্যেও চুপচাপ তাঁর কাজটি করে গেছেন।এই গল্পের নামকরণ হয়েছে রসময়ীর রসিকতা’- আসলে এ রসিকতা তো বিনোদিনীর কারণ। বিনোদিনী এই পত্র লেখা ও পাঠানোর একজন অন্যতম শারিক। মনে রাখা দরকার রসময়ী মৃত, তার বেঁচে থাকার সময় সব চিঠির পরকিল্পনা বিনোদিনীর মনের ইন্ধনেই ডাকে ফেলা হয়েছে। ফলে গল্পে বিনোদিনী যে সমস্ত ছোটো বড়ো ঘটনা, সক্রিয়তার চালিকা শক্তি-বুদ্ধি ও বিবেক ধরে তা গল্পের শেষে ধরা পড়ে যায়। বিনোদিনী তখনও অবিচল। তুলসী তলায় বসে সমস্তটাই দেখেছেন। ক্ষেত্রমোহন তাকে প্রশ্ন করেছেন। “ঠাকুররি এসব কী? – ঠাকুরকি আপন মনে মালা জপ করেছে।” ফলে নামে বিনোদিনীর অন্তরালের ভূমিকা অবহেলিত, মূল তাৎপর্যের ভিতরে সে আড়াল। সমগ্র গল্পে বিনোদিনী হয়ে উঠেছে কাব্যের উপেক্ষিতা।

 

3। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পটি ভূত ছাড়া ভূতের গল্প- আলোচনা করো।

 

উত্তর : সাহিত্যে ভূতের গল্প লেখকেরা কেউই ভূত সম্পর্কে সচেতন বিশ্বাসে বিশ্বাসী নয়। ভূত বা ভৌতিক পরিবেশ রচনাকালে তারা অনুভূতির ওপরেই বেশি জোর দেন। পাঠক যখন অলৌকিকতায় প্রায় নগ্ন ও শিহরিত ঠিক তখনই অতি প্রাকৃত বা অলৌকিকতার মায়াজাল ছিন্ন করে। লেখক প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরে। গল্প শেষ হয় কিন্তু পাঠকের হতবুদ্ধির অবস্থা কাটতে সময় লাগে। রবীন্দ্রনাথও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘জীবিত ও মৃত’ প্রভৃতি গল্পে এই কৌশলই অবলম্বন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও সেই একই পদ্ধতি গ্রহণের আরা রসময়ীর অলৌকিকতাকে ছিন্ন করে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছেন।

“রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে লেখক কখনই ভূতের কথা বলেননি। রসময়ী মারা গেছে। তার মৃতদেহ গঙ্গার তীরে দাহ করা হয়েছে। নিঃসন্তান হওয়ার তার স্বানী মুখাগ্নি করেছেন—এসব তথ্য গল্পের মধ্যেই তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।

ক্ষেত্রমোহনের দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা শুরু হতেই রসমরীর লেখা চিঠি ডাকযোগে ক্ষেত্রমোহানের কাছে এসেছে। এ চিঠি যে জাল নয়, রসময়ীর নিজের হাতে লেখা সে বিষয়ে ক্ষেত্রমোহানের কোনও সন্দেহ নেই। এমনকি তিনখানা চিঠি একইভাবে এসেছে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। আশ্চর্য এই যে, তিনটি চিঠি রসময়ীর হাতে লেখা। ফলে রহনা আরও ঘনীভূত হয়েছে। ভূতের অস্তিত্ব সম্পর্কে পাঠকের বিশ্বাস ও অবিশ্বাস সম্পর্কে দোলাচল অবস্থার পাকাপাকি ভাবে সংযত রূপ দেওয়ার জন্য। থিয়োজফিস্ট তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছে।

ভূতের ভয় ও রসনরীর স্বামীর অসহায়তার চরম রূপ তুলে ধরার পক্ষে মধ্যবর্তী ভৌতিক রসকে লেখকের পক্ষে বিশ্বাস করার অভিনব প্রয়াসের মধ্য দিয়ে দিয়োজফিস্টের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্কের উপস্থাপনা করেছেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে বটগাছের তলার গা ছম ছম করা অবস্থা ভূতের অস্তিত্ব অবিশ্বাসকারীদের প্রতি যেন এক তীক্ষ্ণ বিলুপ এই গল্পে ভূতের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুরেন্দ্রনাথ বাবু ও মনোহরবাবুর মধ্যে ক্রমণ তর্কবিতর্ক হয়েছে। তাই তৃতীয় চিঠি আসার পর মনোহরবাবুর তৎপরতায় এই চিঠিগুলি পিয়োজনিক্যাল রিভিউ-তে প্রকাশিত হল। বড়ো বড়ো থিয়োজকিস্টদের চিঠিপত্র এবং তাদের আগমন ও প্রত্যাগমনে ক্ষেত্রমোহন-এর নাম চতুর্দিকে বিস্তৃত হল। ভূততত্ত্বের অবিশ্বাসীদের আপাত পরাজয় ও বিশ্বাসীদের আপাত জয়ের মধ্য দিয়ে লেখক অপূর্ব শিল্পকৌশলে পাঠকের আগ্রহকে ক্লাইমেন্সের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। টানটান পরিস্থিতির মধ্যে ভূততত্ত্বে বিশ্বাসীদের পাল্লাটি ভারী হয়েছে।

ঠিক তখনই প্রভাতকুমার সেই বিশেষ মুহুর্তাকে অত্যন্ত সংযত স্বভাবে ও শৈল্পিক নিপুণতায় পাঠকদের রস নিষ্পত্তির মুক্ত সুযোগ এনে দেয়। হদয়ের সুর্বলতার উপর নির্ভরশীল যে বিকাশ তা টান দিয়ে উপড়ে ফেলে বৃদ্ধি নির্ভর বিশ্বাসকে স্থান দেওয়া হয়েছে- “সমস্ত ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো তখন ক্ষেত্রমোহানের নিকট পরিষ্কার হইয়া গেল। গল্পকার বুঝিয়ে দিলেন মৃত্যুতেই জীবনের পরিসমাপ্তি, মৃত্যুর আর পর নেই।

 

4। ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শিল্পভাবনার পরিচয় দাও

 

উত্তর। রবীন্দ্র উত্তর বলিষ্ঠ গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। যদিও তিনি রবীন্দ্রগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ছোটোগল্পের আঙিনায় একই শূন্যতাবোধ থেকে যায়, সেই শূন্যতাবোধ পূরণে এগিয়ে আসেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৩১৬ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায়, এই গল্পটির মোট পরিচ্ছেদ সংখ্যা আটটি। কাহিনি ধীরে ধীরে পরিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জটিল আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত শিল্পপ্রকরণে ভৌতিকরসে আপ্লুত হয়ে পারিবারিক সম্পর্ক ভাবনার মজায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু গল্পের খাঁজে খাঁজে যে শিল্পভাবনার পরিচয় দিয়েছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তা এখানে আলোচনার বিষয়।

বাংলার মোক্তার ক্ষেত্রমোহনবাবুর দীর্ঘ-আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবন তিরিশ বছর বয়সী রণরঙ্গিণী স্ত্রীর সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ, সমস্যা, সংঘাত, সংকটে জড়িয়ে থেকে তাঁর প্রাণকে ওষ্ঠাগত করে তোলে। তাই গল্পকার রসময়ীর বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে—“স্ত্রী সমরীর বয়স ত্রিশ। ‘রসময়ী’-এ নাম যে রাখিয়াছিল বলিহারি তাহার প্রতিভা। তবে রসও অনেকগুলি আছে কিনা—এক্ষেত্রে রৌদ্ররস।” যা ছিল রৌদ্ররস তাই এই গল্পে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে ভয়ানক রস। গল্পটি বারবার পড়ে মনে হয়েছে যেন একটি গোয়েন্দা গল্পের রহস্যময়তার দিকে গল্পটি এগোচ্ছে। কোনও এক সামান্য ঘটনায় স্ত্রী রসময়ী ক্ষেত্রমোহনবাবুকে ঘরছাড়া করে। নিজে নায় হালিশহরের পিত্রালয়ে, ক্ষেত্রমোহনবাবু হুগলির বাড়িতে ফিরে যান এই প্রতিজ্ঞা করে যে, তিনি স্ত্রীর মুখদর্শন। কোনও ক্রমেই করবেন না। অন্য জায়গায় বিবাহ করবেন।

‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পের মূল উদ্দেশ্য হল — স্বামী-স্ত্রীর তীব্র বিরোধ, সাংসারিক পারস্পরিক বিবাদের কথা মনে রেখে স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীর বিড়ম্বিত, দুর্ভোগের জীবন চিত্র অঙ্কন। এখানে তিনটি চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়- বিনোদিনী, ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ী। এদের মধ্যে বিনোদিনীর গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ সমগ্র গল্প ভাবনার নেপথ্যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে রসময়ীর আচরণ। ও চিঠি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, আসলে তা নয়। ক্ষেত্রমোহন স্বস্থানে ঠিক আছেন। রসমরীর মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকার মধ্যে চরিত্রের মোটিভ গুরুত্ব পেতেই পারে, তবে গল্পের রসমরীর বেঁচে থাকা ও মৃত্যুর পরের যাবতীয় প্রকাশ্য ও গোপন কর্মকান্ডের একমাত্র হোতা কিন্তু বিনোদিনীই। সমগ্র গল্পটির কলাকৌশল ও শিল্প নৈপুণ্য আসলে বিনোদিনীর হাতে।

গল্পে রসময়ী যারা গেছে, ক্ষেত্রমোহনবাবু নিজে মুখাগ্নি করেছেন, পরবর্তীকালে রসমরীর অস্তিত্ব দিব্যি বজায় থেকেছে, অথচ তাকে ক্ষেত্রমোহনবাবু-অস্বীকার করতে পারেন নি। এক্ষেত্রে রসময়ীর বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টিই গল্পের পরবর্তী অংশের সঙ্গো পূর্ববর্তী অংশের গ্রন্থিবন্ধন করেছে। রসময়ীর মৃত্যুর পরও ক্ষেত্রমোহনের চল্লিশ বছর বয়সেও এক তেরো বছরের বালিকাকে বিবাহের বাসনা—এটা গল্পে উল্লেখিত সত্য। সামাজিক এই ব্যবস্থাকে যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঁকা চোখে দেখেন নি তার প্রমাণ এই গল্পে আছে। এবং এটাও এক শিল্পী মানসের নিরপেক্ষ বা যুক্তিকামী মনের পরিচয়কে বহন করে। আবার গল্পের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে রসময়ী স্বামীর এই কাঙ্ক্ষিত বিষয়টিকে যথাযথ মূল্য দিয়েছেন সেই সামাজিক পরিবেশে থেকেই। মৃত্যুর পরও যেন স্বামী বিবাহ করতে না পারে তার জন্য একের পর এক চিঠি পৌঁছানোর ব্যাপারটাই প্রমাণ করে দেয়।

রসময়ীর মৃত্যুর দুমাস পরেই ক্ষেত্রমোহনবাবু দ্বিতীয়বার বিয়ের জন্য নায়ের কন্যাকে পাত্রী হিসাবে পছন্দ করেছে। কিন্তু রসময়ীর মৃত্যুর পরেও একের পর এক ভৌতিক পত্র পাঠিনো স্বামীকে দ্বিতীয়বার বিবাহের ইচ্ছাকে বিরত করার জন্য জব্দ ও শাসন করার জন্য প্রহসনাত্মক প্রয়াস। এই প্রয়াসের গোপন রহস্যটিকে নিয়েই গল্পকারের এমন গল্প রচনা। এই গল্পের গোপন চাবিকাঠি হল এই ভৌতিক চিঠিগুলি। রসময়ীর মৃত্যুর পরেও পার্থিব জগতে তার অস্তিত্ব বজায় থাকার বিষজফিস্ট তর্ক, বিতর্কের বিচার বিভ্রান্তিতে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এখানে সুকৌশলে নিছক ভূততত্ত্ব ও ভৌতিক ভয় সৃষ্টির কারুকলা ও সেসবের বিফলতা দেখাতে গিয়ে ছোটোগল্পটিকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এই গল্পে কোনও গভীর জটিল মনস্তত্ত্ব নেই। মৃত বা জীবিত চরিত্রের আত্ম উম্মোচনের কোনও প্রয়াস এতে নেই। নিছক সম্পর্ক নিয়ে খেলা গল্পের কেন্দ্রীয় ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। এখানেই এই গল্পের শিল্প সার্থকতা।

পরপর তিনখানি চিঠি এসেছে। প্রথম চিঠিতেই রসময়ীর মৃত্যুর পরেও তার অস্তিত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। ঠিকানা হয়েছে ক্ষেত্রমোহনবাবুর বাড়ির সামনের বটগাছে। কারণ সেখান থেকেই ক্ষেত্রমোহনবাবুর গতিবিধি ভালো দেখা যাবে। এছাড়াও রাত্রে মাঝে মাঝে তার শোবার ঘরে এসে বিছানার চারদিকে ঘুরে বেড়ানোও যাবে, তাই প্রথম চিঠিতে পরিষ্কার জানানো হয়েছে যে রসময়ী মরলেও তার হাত থেকে ক্ষেত্রমোহনবাবুর মোটেই নিষ্কৃতি নেই। এই চিঠি পাওয়া সত্ত্বেও পরের দিন বিবাহের আশীর্বাদ হয়ে যায়। এরপর আসে দ্বিতীয় চিঠি, সেখানেও রসময়ীর নাম স্বাক্ষরিত চিঠি। সেখানে রসময়ীর কঠিন ক্রুদ্ধ শাসন এই বিবাহ করলে রসি বামনির হাতে তার রাতে ঘুম আর কোনওদিনই ভাঙবে না। রসময়ীর প্রতি ভয় আসক্তিতে প্রায় একবছর অতিক্রান্ত হয়। তখন ঠিক হয় গয়ায় রসময়ীর পিন্ড দিয়ে এসে বিবাহ করলে ভালো হয়। সেই সময় একটা মামলায় জড়িয়ে পড়ার ফলে গয়া যেতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে তৃতীয় চিঠি এসে হাজির হয়। এই চিঠিতেও শাসানি আছে। গয়া যেতে নিষেধ করা হয়েছে। গয়া গেলে চোরের বেশে রেলগাড়িতে প্রবেশ করে বুকে ছুরি বসিয়ে দেবার কথা বলা হয়েছে। থিয়েজেফি শাস্ত্রে অশরীরী আত্মা মানুষের বুকে ছুরি বসাতে পারে কিনা—এইসব জটিল ভূততত্ত্ব আলোচনার মধ্যে আর বিবাহই হল না।

গোয়েন্দা গল্পের মতো টান টান রহস্য। এই পরপর তিনটি চিঠি আসায় পাঠকও ভাবছে যে এটা অবিশ্বাস্য কিন্তু এটাও বুঝছে যে এর মধ্যে একটা রহসা আছে। চিঠি জাল প্রমাণিত হলে রহস্য আর রহস্য থাকত না। তবে প্রভাত মুখোপাধ্যায় এটাকে রহস্য ভেবেই গল্পের আকর্ষণকে শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পেরেছেন। চিঠিগুলিও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েও আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রবল। এর মধ্যে এক সময়ে নিজের দুর্ভাগ্যের দুঃখে বিষন্ন ক্ষেত্রমোহনবাবু যখন গভীর দুঃখিত, তাঁর কাছে হঠাৎ খবর আসে, তাঁর হালিশহরের শ্বশুরবাড়িতে দোলের উৎসবে বাজি পোড়াতে গিয়ে ছোটো শ্যালক সুবোধ জখম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে দেখতে যান ক্ষেত্রমোহন ভাড়া গাড়ি নিয়ে। সেখানে উপস্থিত ছিল বিধবা শ্যালিকা বিনোদিনী। রাত্রি গভীর হয় বিনোদিনীকে হাসপাতালে থাকতে দৈয় না। তখন কী হয় ক্ষেত্রমোহন বিনোদিনীকে নিয়ে হালিশহরে যায়। রাত কাটিয়ে সকালে বিনোদিনীকে এখানে ছেড়ে দিয়ে হুগলি ফিরে যাবে।

ভোরের দিকে ক্ষেত্রমোহন যখন তামাক খেতে উঠেছিল তখন দেখে বাড়ির চারদিকটা পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্ষেত্রমোহনবাবুকে চিনত….. টুমি হেখানে বি খড়িতেছে?… ইহা টোমার শ্বশুড়বাড়ি আছে? উম, হামি টোমার শ্বশুরবাড়ি সার্চ খড়িবে। হেখানে বোমা টেয়াড়ি হয় কিনা ডেখিবে। ইহা সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।” অর্থাৎ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় গল্পের কাঠামোয় এতটুকু মেদ রাখেননি। যখন পাঠক ধীরে ধীরে ভূতকে বিশ্বাস করে নিতে চলেছে তখনই আঘাত হেনেছে ব্রিটিশ পুলিশকে দিয়ে বাড়ি সার্চ করা থেকে বেরিয়ে এল গল্পের কেন্দ্রীয় রহস্যের সঙ্গে একই সঙ্গো ক্ল্যাইম্যাক্স ও পরিণতির কৌতুকরসসিক্ত উতরোল ব্যঞ্জনা। পুলিশের সার্চ করা মালপত্র বাইরে উঠোনে জড়ো করা হল -গুপ্ত পরিকা, কাশীদাসী মহাভারত, বটতলার ছেঁড়া উপন্যাস আর বিনোদিনীর ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল গোটা কুড়ি চিঠি আর কয়েকটি খাম।

গল্পের প্লটের জট সরে এসে ক্ষেত্রমোহন ও বিনোদিনীর পারস্পরিক বিপরীতমূলক ভাবনার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যায়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এতক্ষণ এই সিচুয়েশন-এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তাই তিনি এই সিচুয়েশনকে অত্যন্ত সংযতভাবে কাজে লাগিয়ে স্বভাবে ও শৈল্পিক নিপুণতায় পাঠকদের রস নিষ্পত্তির মুক্ত সুযোগ এনে দেয়। জীবিত রসময়ীর দিক থেকে নানা অবস্থা কল্পনা করে অনুমানে চিঠিগুলি লেখার কৌশল মোত্তার ক্ষেত্রমোহনবাবুর পক্ষে মেঘের অপসারণে স্বচ্ছতার আকাশ দেখা যায়। ব্যঞ্ছনায় শিল্পরসিক পাঠকদের মনকে দ্বিধাযুক্ত করে দেয় শেষের লাইনগুলি – ক্ষেত্রমোহন বলিলেন—“ঠাকুরঝি, এসব কী?”—ঠাকুরঝি আপন মনে মালা জপ করিয়া। বাইতে লাগিলেন।

5। রসময়ীর রসিকতা গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

 

উত্তর। কোনও রচনার নামকরণ অনেকটা দোকানের সাইবোর্ডের মতো। দোকানের সাইনবোর্ড দেখলে জানা যায় সেই দোকানে প্রাপ্তব্য বস্তুর সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে। অনুরূপভাবে কোনও সাহিত্যের নামকরণ সেই রানার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা দেয়।

নামকরণ মূলতঃ তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হতে পারে – (১) রচনার বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক (২) রচনায় উল্লিখিত প্রধান চরিত্র কেন্দ্রিক এবং (৩) ব্যঞ্ছনাধর্মী। এখন আমরা গল্পের কাহিনী আলোচনা করে দেখব এই গল্পের নামকরণ কতটা বিষয়ানুসারী বা চরিত্রানুগ।

জেলা কোর্টের খ্যাতনামা মোস্তার ক্ষেত্রমোহন কোর্টে বিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে দক্ষ হলেও বাড়িতে তিনি তার স্ত্রী ভ্যাংকরী রসময়ীর কাছে মেষশাবকের ন্যায় হীন ও অসহায়। স্ত্রী ভয়ে তিনি গৃহছাড়া থাকার পর তার স্ত্রী রসময়ী পিত্রালয়ে গেলে তিনি বাড়ি ফেরেন। হরিশবাবু কন্যার সঙ্গে ক্ষেত্রমোহনের দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব বানচাল করতে রসময়ী বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে হরিশবাবুর বাড়িতে চড়াও হয়। হরিশবাবুর স্ত্রী রসময়ীকে দজ্জাল বলায় রসময়ী তাকে ঝাঁটাপেটা করেন। গৃহিণীর অবস্থা দেখে সকলে আত্মগোপন করে এবং দাসী চীৎকার শুরু করায় রসময়ী সকলকে খুন করে দেবার হুংকার দিয়ে হরিশবাবুর বাড়ি থেকে পালায়।

ক্ষেত্রমোহনকে জিজ্ঞাসা করে তার দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে যে ক্ষেত্রমোহনকে ভয় দেখিয়ে দ্বিতীয়বার বিবাহ করা থেকে নিবৃত্ত করেছে।

এদিকে অস্তিমশয্যায় শায়িতা রসময়ীর চিকিৎসার জন্য ক্ষেত্রমোহন হালিশহরে এসে বহু চেষ্টা কারেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না। রসমসীর পারলৌকিক কর্মসম্পাদন করে ছয় মাসের মধ্যে বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্য হুগলির কাছে একটি মেয়েকে পছন্দ করলেন। দ্বিতীয় বিবাহের আশীর্বাদ সম্পন্ন হবার পর ক্ষেত্রমোহন রসময়ীর জবানবন্দীতে একটি চিঠি পেলেন, যাতে বলা ছিল যে রসময়ী গৃহসমূহস্থ বটবৃক্ষবাসিনী হয়েছেন এবং বিয়ে করলে তার কপালে অশেষ দুর্গতি অপেক্ষা করে আছে।

গল্পের মূল কাহিনি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল রসমরী। তাকে কেন্দ্র করেই মূল কাহিনি অগ্রসর হয়েছে। রসময়ী তার কার্যকলাপের মাধ্যমে গল্পের মধ্যে এক হাস্যরসাত্মক পরিবেশ রচনা করেছেন। ক্ষেত্রমোহন স্ত্রী রসময়ীর দজ্জালপনায় তার জীবৎকালে গৃহে অসহায় জীবনযাপন করেছেন এবং তার মৃত্যুর পরেও পত্রমারফত তার অশরীরী উপস্থিতি জানান দিয়ে ক্ষেত্রমোহনের দ্বিতীয় বিবাহের উদ্যোগকে স্থগিত করে দিয়েছেন।

প্রভাতকুমারের এই গল্পটি হাস্যরসের আধারে পরিবেশিত। জীবনের এক সুগভীর সত্য এখানে নিহিত আছে। রসময়াঁর আচার ব্যবহারে নিম্নরুচির রক্ষারসের আধিক্য জীবনসত্যের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েছে। আপাতহাসির অন্তরালে এখানে অশ্রুর আধিক্যও উল্লিখিত হয়েছে যা আমাদের হৃদয়কে সহজেই স্পর্শ করে।

হাস্যরসসৃজনকল্পে ছোটোগল্পকার তার শিল্পোৎকর্ষতাকে পরিপূর্ণরূপে নিয়োজিত করেছেন। রসময়ীর চরিত্রের যাবতীয় অসম্পাতির মূলে তার অপরিচিত কোষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ক্রোধ প্রকাশের জন্য যে প্রতিপক্ষের প্রয়োজন এক্ষেত্রে স্বামী ক্ষেত্রমোহনই তার প্রতিপক্ষরূপে চিত্রিত। এমনি ভাবেই রসময়ীর চরিত্রে রৌদ্ররসের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়ে সমগ্র গল্পটিকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

এই ছোটোগল্পটির মূল অবয়ব রসময়ীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তার দাম্পত্যজীবনের সস্তানহীনতারূপ অসম্পূর্ণতা তার চরিত্রে ক্রোধের আধিক্য ঘটিয়েছে। সেই ক্রোধের বহির্ভূতাকাশ তার আচার-আচরণে প্রতিভাত হয়েছে। সেই ক্রোধ ক্ষেত্রমোহনের গৃহজীবনকে বিস্ময় করে তুলেছে। রসমরীর কার্যকলাপকে লেখক রসিকতার আধারে বিচার করেছেন। তাই গল্পটির নামকরণ করেছেন। “রসময়ীর রসিকতা’। ‘রসিময়ীর রসিকতা’ গল্পটি আদ্যন্ত হাস্যরসাত্মক। রসময়ী ও ক্ষেত্রমোহনের আঠারো বছরের।

দাম্পত্যজীবন এবং সমস্যাকে কেন্দ্র করেই গল্পের গতি পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। তাই সাংসারিক জীবনযুদ্ধ এবং রসময়ীর কার্যকলাপকে লেখক রসিকতা হিসাবে বিবেচনা করে গল্পের নামকরণ করেছেন। তাই এই গল্পের নামকরণ চরিত্রকেন্দ্রিক ও বিষয়ানুগ হয়ে সার্থকনাম হয়েছে।। এ গল্পের বিষয়বস্তু এবং পরিণতির বিচারে অন্য নাম কল্পিত হতে পারে না।

 

6। রসময়ীর রসিকতা গল্পে রসময়ীর চরিত্র বিচার করো।

 

উত্তর। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা ছোটোগল্পের ধারায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় একটি উজ্জ্বলতম নাম।

তার হাস্যরসাত্মক ছোটোগল্প রসময়ীর রসিকতায় জীবনের একটি সুগভীর সত্য নিহিত আছে। এই গল্পে আপাতহাসির অন্তরালে অশ্রু আধিক্যও বিরাজমান যা সহজেই আমাদের হৃদ্যাকে স্পর্শ করে। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রসময়ী এবং তাকে ঘিরেই এই ছোটোগল্পের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। রসমগ্রী ও ক্ষেত্রমোহন দাম্পত্যপ্রবাহের একটি অংশ। তাদের বিবাহিত জীবন আঠারো বছরের। কিন্তু তাদের কোনো সন্তান ছিল না। তাদের সন্তানহীনতা তাদের দাম্পত্যজীবনকে বিড়ম্বনাময় করে তুলেছিল। সন্তানের অভাবজনিত মানসিক সত্তাপ রসময়ীর মনোজগতকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। স্বামীকে কেন্দ্র করে তার মনে এক বিক্ষোভ বলয় সৃষ্টি হয়েছিল। এই মানসিক বিক্ষোভ থেকেই স্বামীর প্রতি তার আস্থাহীনতা জন্ম নিয়েছে। যে স্বামী তাকে সন্তানসুখে সুখী করতে পারেনি। সেই স্বামীকে সুখপ্রদানে তার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে বিবাহোত্তর দাম্পতজীবনে তাদের যুদ্ধ আর সন্ধির পারম্পর্য চলেছে।। এমনিতে রসময়ী কলহপ্রিয়া ও রণরক্মিণী নারী। এর সাথে তার বিকৃত মানসিকতা যুক্ত হয়েছে। তার বয়স ত্রিশ উত্তীর্ণ। তাই সন্তানের আশা সে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু একটা ভয় তার বুকে অচলায়তন পাথরের মতো চেপে বসেছে। সে সর্বদা চিন্তিত পাছে ক্ষেত্রমোহন, তার স্বামী, তাকে সন্তানহীনতার জন্য দায়ী করে দ্বিতীয়বার বিবাহ করে।

স্বামীর সঙ্গেঙ্গ ঝগড়া করে সে স্বামীকে বাড়িছাড়া করেছে। রসময়ী তার বাপেরবাড়ি চলে যাবার পর সে আবার গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। মাসাধিককাল পিত্ৰালয় হালিশহরে কাটাবার পর ক্ষেত্রমোহন তাকে আগের মতো নিতে না আসায় সে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রসমবীর জানা ছিল, ক্ষেত্রমোহনের মাসি-পিসিরা তার দ্বিতীয়বার বিয়ে দেবার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। ঠিক এই সময়ে রসময়ী জানতে পারে যে ক্ষেত্রবাবুর দ্বিতীয় বারের বিবাহ পাকাপাকি স্থির হয়ে গেছে। ফলে রসময়ী তখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

সতীন নিয়ে সংসার করতে কোনও মেয়ে চায়না, ফলে রসময়ী তা চায়নি। তাদের দাম্পত্যজীবনে অন্য একজন এসে ভাগ বসাবে এটা মেনে নেওয়া রসময়ীর পক্ষে সম্ভব ছিল না, স্বামীর উপর সেরকম প্রভাব না থাকায় বিয়ে আটকাতে সে নিজেই দিদি বিনোদিনীকে সন্ধ্যে নিয়ে আসরে অবতীর্ণ হয়েছে। এই আচরণের মাধ্যমে আমরা রসমাধীর জেল, বৃত্তিমতা এবং নারীসুলভ স্বাভাবিক মানসিকতার পরিচাা লাভ করি।

হরিশবাবুর গৃহে উপস্থিত হয়ে বিনোদিনাই কথা-বার্তা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু হরিশবাবুর স্ত্রী দুটি বিশেষণ রসময়ী প্রসঙ্গে উল্লেখ করায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রথমে তাকে পরিভাষা এবং পরে দজ্জাল বলার রসময়ী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়। বারান্দার কোণে পড়ে থাকা কাঁটা তুলে সে গৃহিণীকে মারতে শুরু করে এবং বলে—“আমার সোয়ামী ছাড়া কী তোমার মোনোর অন্য পাত্তর জুটলো না। জুটলো না?” আলোচ্য উত্তি এবং তার আচরণ তার ক্রোধ এবং প্রতিহিংসা পরামর্শতার দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।

রসময়ী ক্রুদ্ধ ছিল ঠিকই কিন্তু সে দিখিনিক জ্ঞানশূন্য হয়নি। সে বুদ্ধিমত্তা সহকারে লোকজন আনার আগেই দিদির সঙ্গেঙ্গ খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে চালককে পারঘাটায় যাবার নির্দেশ দিয়েছে। তাই তার পলায়ন করার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর মেলে। হরিশবাবুর গৃহে গৃহিণীকে ঝাঁটা পেটা করার মাধ্যমে রসময়ীর রাগের থেকে অভিনয়টাই প্রকট হয়ে উঠেছে। যে যখন মাথায় আঁশরটি ঘুরিয়ে পাগলের মতো বলেছে “আমার খুন চেপেছে—সবাইকে খুন করে ফাঁসি যাব।” তাতে তার অভিষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। মেয়েরা ভয়ে ঘর বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করেছে আর রসময়ী অবাধে দিদির সঙ্গে নিরাপদে সে স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে। তার আচরণের মাধ্যমে সে অন্তত হরিশবাবুর পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে, তার মেয়ের বিয়ে ক্ষেত্রমোহনবাবুর সাথে দেওয়া ঠিক হবে না। হরিশবাবুর থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে ক্ষেত্রমোহন নিজের বাড়িতে হুঁকা টানার সময় রসময়ী হাজির হয়ে তার শ্যেন দৃষ্টিতে ক্ষেত্রমোহনকে বিদ্ধ করে। সে যখন জানতে পারে যে ক্ষেত্রমোহন দ্বিতীয় বিবাহে অনড়, তখন সে জানিয়ে দিয়েছে ক্ষেত্রমোহন বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে করলে সে কেবল আশরটি দিয়ে নববধূর নাক কেটে দেবে আর তার বুকে একটা দশমুখে পাথর চাপিয়ে দেবে।

রসময়ী রাগী, কলহপরায়ণা হলেও তার চরিত্রে বন্ধনহীন দাম্পত্যজীবনের একটি বিয়োগান্ত দিক প্রস্ফুটিত। সন্তানহীন দাম্পত্যজীবনের মরুভূমিতে সন্তানরূপে ওয়েসিসের সন্ধান লাভে ব্যর্থ হওয়ায় স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক নতুন পথে বাঁক নেয়নি। রসময়ীর উৎকেন্দ্রিক চরিত্রে নাস্তি গহ্বরে পতিত হয়ে দিকভ্রষ্টা হয়েছে। রসময়ীর কলহপরায়ণা উৎকেন্দ্রিক চরিত্রের পশ্চাতে স্বামী ও সংসারের প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ কিন্তু স্পষ্ট প্রতীত হয়। স্বামীর প্রতি আকর্ষণ বশতই সে স্বামীকে অন্য কোনও মেয়ের হাতে ছেড়ে দিতে চায়নি।

রসমগ্রীর দাম্পত্যজীবন মলয় বাতাস স্নিগ্ধতার পরশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে প্রখর রৌদ্রের শুদ্ধ তাপ থাকলেও বসন্তের হিল্লোল ছিল না। কিন্তু তাদের দাম্পত্যজীবন মরুবালুকায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। মরুদ্যানের নির্জনতায় সে আপন অস্তিত্ব যথাযথভাবে বজায় রেখেছে।

7। রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে ক্ষেত্রমোহনের চরিত্র বিচার করো।

 

উঃ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের “রসময়ীর রসিকতা” গল্পে ক্ষেত্রমোহন কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র।

যদিও গল্পে মুখ্য ভূমিকায় রসময়ী প্রাধান্য লাভ করেছে তবুও ক্ষেত্রমোহন অন্যতম প্রধান চরিত্র। ক্ষেত্রমোহন জেলা কোর্টের প্রখ্যাত মোক্তার। আদালতে তিনি বিপুল উদ্যমসহকারে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে থাকেন। কিন্তু বাড়িতে তিনি মেষশাবকতুল্য হীন এবং অসহায়। কলহপ্রিয়া ও দজ্জাল স্ত্রীর ভায়ে তিনি গৃহছাড়া হয়েছেন। স্ত্রী পিত্রালয়ে গমন করার পর তিনি সাহস করে বাড়ি ফিরে এসেছেন। জেলা আদালতের প্রখ্যাত মোত্তার মেষশাবকের মতো অসহায় অবস্থায় বিরাজ করার গল্পে হাস্যরস সৃজনের সহায়ক হয়েছেন।

নারীকে কেন্দ্র করেই সংসার ও দাম্পত্যজীবন আবর্তিত হয়। সন্তানরূপী সেতুবন্ধনে আবদ্ধ হয় নদীর উভয় তীর। আবহমান কাল থেকে বলে আসা এটাই আমাদের সমাজব্যবস্থার দাম্পত্য নীতি। ক্ষেত্রমোহন রসময়ীকে বিয়ে করেছেন আঠারো বছর। কিন্তু তাদের কোনও সন্তান নেই। সস্তানের অভাবে মানসিক সন্তানহেতু স্বামী ক্ষেত্রমোহনের বিরুদ্ধে রসময়ীর এক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।

ক্ষেত্রমোহানের সঙ্গে ঝগড়া করে তার স্ত্রী রসময়ী পিত্রালয়ে চলে গেছে। বাড়িতে রসময়ী না থাকায় সে বাড়ি ফিরে এলেও প্রতিজ্ঞা করে যে সে আর রসময়ীর সুখদর্শন করবে না। পুনরায় বিয়ে করার জন্য সে উদ্যোগী হয়। এইবারই প্রথম স্ত্রীকে তার মান ভাঙিয়ে ক্ষেত্রমোহন তার পিত্রালয় থেকে ফিরিয়ে আনতে যায়নি। এ থেকে তার জেদের পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি। ক্ষেত্রমোহনের মাসি পিসিরা তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। তিনি হুগলির। কাছে তার বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে দিলেন। এমনকী তার আশীর্বাদ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু সে সময় হুগলি রা4 স্কুলের এক ছাত্রের কাছ থেকে ক্ষেত্রমোহনের বিবাহসংবাদ রসময়ীর কাছে পৌঁছালে তিনি সেই বিবাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তার বুদ্ধিমত্তা ও রণরঙ্গিণী মূর্তির মাধ্যমে।

আদালতে হরিশবাবুর মুখ থেকে ক্ষেত্রমোহন রসময়ীর কার্যকলাপ শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।

তিনি যেমন বাড়িতে বসে হুঁকা টানছিলেন তখন রসময়ী হাজির হয়ে তাকে তার দ্বিতীয় বিবাহ সম্বদ্ধে প্রশ্ন করায় তিনি কিছুটা সাহস সময় করে সম্মতি জানান। এর ফলে রসময়ী ক্ষেপে ওঠেন এবং তার সজনকে কিভাবে শাস্তি দেবেন তা তাকে অবহিত করেন।

রসময়ীর এহেন কার্যকলাপ ক্ষেত্রমোহনের দাম্পত্য জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। সে রসময়ীর বাক্যবাণে বিপর্যস্ত। সে জন্যই সে বাধ্য হয়ে জানিয়েছে – “তুমি না মরলে আর বিয়ে করছিনে। মরবে কবে?” ক্ষেত্রমোহনের এরূপ উক্তি তার হতাশা এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

স্বামী হিসাবে ক্ষেত্রমোহন অপদার্থ। স্ত্রীর উৎকেন্দ্রিক চরিত্রের যন্ত্রণার দিকটি সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। গল্পের শুরু থেকেই সে যেন রসময়ীর প্রতিপক্ষ। যৌবনের আবেগ কমে আসার পর তাদের দাম্পতজীবনে অনৈক্যটাই প্রকটিত হয়েছে। দুই অনাসক্ত নিস্পৃহ হৃদয়কে একত্রে বেঁধে দেবার কোনও অবলম্বন তাদের ছিল না। ফলে ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ী দুটি চরিত্রই কেন্দ্রচ্যুত হয়ে নিজ নিজ আবর্তের মধ্যে হাবুডুবু খেয়েছে। রসময়ীর জীবদ্দশায় ক্ষেত্রমোহন তার প্রতি আকর্ষণের বিষয় সম্বন্ধে অবহিত ছিল না। কিন্তু রসময়ী রোগশয্যার শায়িতা হতেই ক্ষেত্রমোহন আর তাকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারেনি। নিজে হালিশহরে হাজির হয়ে সাধ্যমতো রসময়ীর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছে। মৃত্যুর পর রসময়ীর মুখাগ্নি করেছে। গঙ্গা তীরে শ্মশানের আগুনে প্রজ্জ্বলিত রসময়ীর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে সাশুনেত্রে তার স্মৃতিতর্পণ করেছে। সে হৃদয়সৰ্ব্বাত প্রেমকে অস্বীকার করতে পারেনি।

ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ীর দাম্পত্যজীবনে মলয় বাতাসের স্নিগ্ধতা ছিল না। বসন্তের হিল্লোলও ছিল না, কিন্তু তাদের মধ্যে এক দাম্পতা আকর্ষণ ছিল যা নির্জনতার মধ্যেও আপন অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।

 

শেষ কথা : প্রিয় পাঠক গণ আজকে শেষ হলো রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ । আশা করি তোমাদের রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ পড়তে ভালো লাগছে । আরো  নতুন নতুন রসময়ীর রসিকতা গল্প প্রশ্ন উত্তর ২০২৪ পেতে আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ।

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *