অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর

আজকের বিষয় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ইউনিভার্সিটি এর বাংলা সেকেন্ড সেমিস্টার এর অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর তাই সমস্ত অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর নিচে দেয়া হল তোমরা চেক করে নাও

 

অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর

অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর| অতি সংক্ষিপ্ত / সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ২০২৪

 

১। বৃদ্ধ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কটি ছেলে মেয়ে?

উঃ বৃদ্ধ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের চার ছেলে, তিন মেয়ে।

২। ‘আর একটি প্রাণী একটু দূরে থাকিয়া এই দলের সঙ্গী হইল।’—কাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে?

উ: কাঙালীর মা-র কথা বলা হয়েছে।

৩। গ্রামের কোথায় শ্মশান অবস্থিত?

উ: গ্রামের একান্তে গুরুড় নদীর তীরে শ্মশান।

৬। ‘আমাকেও আশীর্বাদ করে যাও।’—কী আশীর্বাদ করার কথা বলা হয়েছে?

উ: কাঙালীর মা মৃত্যুর পর যেন কাঙালির হাতে আগুন পায়। এই আশীর্বাদ চেয়েছেন।

৭। অভাগী নামকরণের কারণ কী?

উঃ কাঙালীর মাকে জন্ম দিয়ে মা মারা যান, তাই কাঙালীর মায়ের পিতা রাগ করে কাঙালির মায়ের নামকরণ করেন অভাগী।

৮। কাঙালীর মার কার সঙ্গে বিবাহ হয় ?

উঃ রসিক বাগের সঙ্গে বিবাহ হয়।

৯। অভাগী তার শিশুপুত্রকে নিয়ে গ্রামে পড়ে থাকে কেন?

উ: অভাগীর স্বামী অন্য নারীকে নিয়ে অন্য গ্রামে চলে যায়। তাই অভাগী তার শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে পড়ে থাকে।

১০। কাঙালী আজ কত বছরে পা দিয়েছে?

উঃ পনেরো বছরে পা দিয়েছে।

১১। কাঙালী কীসের কাজ শিখতে আরম্ভ করেছে ?

উ: কাঙালী বেতের কাজ শিখতে আরম্ভ করেছে।

১২। ‘ক্যাঙলার মার মতো সতী লক্ষ্মী আর দুলে পাড়ায় নেই’- কে বলেছে একথা ?

উ: আলোচ্য কথাটি বলেছেন বিন্দির মা বলেছে

১৩। কাঙালী কবিরাজকে ডেকে আনার জন্য কী করে?

উঃ প্রথমে কান্নাকাটি করে, হাতে পায়ে পড়ে, তাতেও যখন কাজ হয় না শেষে ঘটি বাঁধা দিয়ে একটাকা প্রণামি দিল। তাতেও কবিরাজ আসলেন না।

১৪। ‘পরদিন সকালে সে হাত দেখিয়া তাহারই সুমুখে মুখ গম্ভীর করিল।’-কে হাত দেখিল ?

উঃ ঈশ্বর নাপিত হাত দেখল।

১৫। কাঙালী জাতিতে কী ছিল?

উঃ দুলে।

১৬। এমন সতীলক্ষ্মী বামুনের কায়েতের ঘরে না জন্মে আমাদের দুলের ঘরে জন্মাল কেন ?-বক্তা কে?

উঃ রাখালের মা।

১৭। বেলগাছ কাটার সময় কে এসে রসিকের গালে চড় কষায়?

উঃ জমিদারের দারোয়ান রসিকের গালে চড় কষায়।

১৮। হিন্দুস্থানি দারোয়ান কাঙালীর গায়ে হাত দিল না কেন?

উ: কাঙালী তার জননীর মৃতদেহ স্পর্শ করে বসেছিল, তাই অশৌচের ভয়ে তার গায়ে হাত দিল না হিন্দুস্থানি দারোয়ান।

১৯। জমিদারের গোমস্তার নাম কী ?

উ: অধর রায়।

২০। কী জাতের ছেলে তুই?’—বক্তা কে?

উঃ বস্তা এখানে জমিদারের গোমস্তা অধর রায়।

২১। অধর রায় কাঙালীর মাকে পোড়ানোর জন্য কত টাকা চেয়েছিল?

উ: পাঁচ টাকা চেয়েছিল।

২২। কাঙালী উত্তরীয় কেনবার মূল্যস্বরূপ কী বাঁধা দিয়েছে?

উ: ভাত খাবার পেতলের ফাঁসি বাঁধা দিয়েছে।

২৩। সে আমার মায়ের হাতে পোঁতা গাছ – কোন গাছের কথা বলা হয়েছে?

উঃ বেল গাছের কথা বলা হয়েছে।

২৪। ‘ব্যাটাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দে’-কার কথা বলা হয়েছে?

উ: কাঙালীর কথা বলা হয়েছে।

২৫। ‘দেখচেন ভট্‌চাযমশায় সব ব্যাটারাই এখন বামুন কায়েত হতে চায়।’—বক্তা কে?

উঃ বক্তা এখানে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বড়ো ছেলে।

২৬। তোদের জেতে কে কবে আবার পোড়ায় রে– বক্তা কে?

উঃ বক্তা এখানে ভট্টাচার্য মশায়।

২৭। কত সময়ের অভিজ্ঞতায় সংসারে কাঙালী যেন একেবারে বুড়ো হয়ে ?

উ: ঘণ্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায়।

২৮। কে কাঙালীর হাতে একটা খড়ের আঁটি জ্বেলে দিয়েছিল?

উঃ রাখালের মা।

২৯। এ যেন বড়ো বাড়ির গৃহিণী, পঞ্চাশ বর্ষ পরে আর একবার নতুন করিয়া তাঁহার স্বামীগৃহে যাত্রা করিতেছে | একথা বলার কারণ কী?

উঃ ঠাকুরদাস মুখুজ্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন। মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পায়ে গাঢ় করে আলতা এবং মাথায় ঘন করে সিঁদুর লেপে দিল, বধুরা ললাট চন্দনে চর্চিত করে বহুমূল্য বস্ত্রে শাশুড়ির দেহ আচ্ছাদিত করে দিয়ে আঁচল দিয়ে তাঁর শেষ পদধূলি মুছে নিল। পুষ্পে, পত্রে, গন্ধে, মাল্যে, কলরবে মনে হল না কোনো শোকের ব্যাপার। ধূমধাম দেখে আলোচ্য মন্তব্যটি করা হয়েছে।

৩০। “তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল, বারংবার বলিতে লাগিল, ভাগ্যিমানী মা তুমি সগ্যে যাচ্ছ।”— ‘ভাগ্যিমানী মা’ কাকে বলা হয়েছে। তিনি ‘ভাগ্যিমানী’ কেন ?

উঃ ধনবান ঠাকুরদাস মুখুজ্জের বর্ষীয়সী স্ত্রীকে ভাগ্যিমানী বলা হয়েছে। বৃদ্ধ ঠাকুরদাস মুখুজ্যের স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন। চার ছেলে, তিন মেয়ে, জামাইরা, প্রতিবেশীর দল, চাকর-বাকর সবাই এসে তাকে শ্মশানে নিয়ে গেল। সে যেন এক বিরাট উৎসব বেঁধে গেল। তাছাড়া নিজ পুত্রদের হাতেও আগুন তিনি পেয়েছেন। তাই অভাগী বামুনের মাকে ভাগ্যিমানী বলে অভিহিত করেছে।

অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর

অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর | মধ্যম মানের প্রশ্ন উত্তর ২০২৫

 

১| ছেলের হাতের আগুন ! সে তো সোজা কথা নয় ! কার উক্তি ? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? উক্তিটির তাৎপর্য বিচার কর ?

 

উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অভাগীর স্বর্গ গল্পে অভাগী অর্থাৎ কাঙালীর মা এই উক্তিটি করেছে। কাঙালীর মায়ের একমাত্র সাধ ছিল মৃত্যুর পর তাকেও যেন দাহ করা হয়। ছেলে কাঙালীর হাতের আগুন পেয়ে সেও যেন স্বর্গে যেতে পারে। ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রী বর্তমানে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি স্বামীর পায়ের ধুলো নিতে পেরেছিলেন। তাঁর ছেলে, ছেলের বউ, কন্যা ও জামাতারা মৃত্যুশয্যা পাশে উপস্থিত ছিলেন। মুখযোগিন্নীকে দু’পায়ে আলতা মাখিয়ে, মাথায় বড় করে সিঁদুর লেপে, কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। এই শ্মশানযাত্রার বর্ণনায় শরৎচন্দ্র লিখেছেন—“পুষ্পে, পত্রে, গন্ধে, মালো, কলরবে মনে হইল না এ কোন শোকের ব্যাপার-এ যেন বড় বাড়ির গৃহিণী পঞ্চাশ বৎসর পরে আর একবার নতুন করিয়া তাঁহার স্বামীগৃহে যাত্রা করিতেছেন। মুখুয্যে গিন্নীর দাহকার্য দেখতে বহুলোক শ্মশানঘাটে ভেঙে পড়েছিল। কাঙালীর মা বাড়ির উঠোনের বেগুন গাছ থেকে গোটা কয়েক বেগুন তুলে হাটে চলেছিল। বিক্রি করতে, দেও শ্মশানঘাটে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু দুলে জাত বলে সে কাছাকাছি যেতে সাহস পায়নি দূরে একটা উঁচু ঢিপির উপর দাঁড়িয়ে সে দাহকার্য দেখছিল। মুথুযোগিনীর মুখে যখন আগুন দেওয়া হল তখন অভাগী কেঁদে ফেলে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে—“মা, তুমি সগ্যে যাচ্ছো আমাকেও আশীর্বাদ করে যাও আমিও যেন এমনি কাঙালীর হাতের আগুনটুকু পাই।” দাহকার্য দেখতে দেখতে অভাগীর মনে হয় যে মুখুযোগিন্নী যেন রথে চড়ে স্বর্গে যাচ্ছেন। অভাগী অবাক বিস্ময়ে চিতার ধূম কুণ্ডলীর দিকে চেয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত কাঙালীর ডাকে তার সম্বিত ফেরে। কাঙালী মাকে জিজ্ঞাসা করে, “বামুনদের গিন্নী মরেছে তুই কেন কেঁদে মরিস মা?” অভাগী কাঙালীকে বলে “কাঁদব কিসের জন্য রে ! চোখে ধোঁ লেগেছে বৈত নয়।”

ঘরে ফিরে কাঙালীর মায়ের জ্বর আসে। জ্বর ক্রমাগত বেড়ে চলে। কাঙালীর মা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে আরম্ভ করে। প্রলাপের ঘোরে সে বারবার ছেলের হাতের আগুন পেয়ে স্বর্গে যাওয়ার আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করে। অভাগী দুলে ঘরের বউ। বিয়ের পরেই সে স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্তা হয়। তার একটি মাত্র পুত্র কাঙালী। কাঙালীকে অবলম্বন করেই সে সংসারে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। তার সারাজীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল ছেলের হাতের আগুন পেয়ে সে পুড়ে মরবে। মৃত্যুর পর ছেলের হাতের আগুন পাওয়া হিন্দু নারীর কাছে অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। তখন আর তাকে দুলের ঘরের বউ বলে, ছোট জাত বলে কেউ অবজ্ঞা করতে পারবে না। অভাগীর সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধটি যেন কান্না হয়ে ঝরে পড়েছে। এই সামান্য উক্তিটির মধ্য দিয়ে সমাজের ছোট জাতি, অখ্যাত পরিবারের একটি নারীর শেষ প্রার্থনার আর্তিটুকু পরিস্ফুট হয়েছে।

 

2. বাগদী দুলের ঘরে কেউ কখনো ওষুধ খেয়ে বাঁচে না।”—কে কোথায় এই উক্তি করেছে? এই উক্তিটির তাৎপর্য আলোচনা কর।

 

উত্তর : আলোচ্য উক্তিটি, কাঙালীর মা অভাগীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে।

অভাগী ছেলের কিনে আনা ওষুধ উনুনে ফেলে দিয়েছে। কেননা ওষুধ সে খেতে চায়নি। অভাগীর মনে তখন মৃত্যু আকাঙ্খা জেগে উঠেছে। তাই অভাগী মন্তব্য করেছে যে বাগদী দুলের ঘরে কেউ কখনও ওষুধ খেয়ে বাঁচে না।

আরোও পড়ুন’ _ মহেশ গল্পের প্রশ্ন উত্তর

অভাগী দুলে ঘরের বৌ, দুলে ঘরের মেয়ে। রসিক দুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বিয়ের পরই স্বামী তাকে ত্যাগ করে। অভাগী একমাত্র ছেলে কাঙালীকে আঁকড়ে ধরে জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিতে চায়। রসিক দুলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর অনেকেই অভাগীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু ছেলের মুখ চেয়ে অভাগী রাজী হয়নি। অবশেষে কাঙালী চোদ্দ বছর বয়সে উপনীত হয়। সে একটি বেতের দোকানে কাজ নেয়। যেদিন সে কাজে যেত জলপানের জন্য দুটি পয়সা পেত। কিন্তু অভাগীর কপালে সুখ ছিল না। মুখুয্যে বাড়ির গিন্নীমার দাহকার্য দেখতে গিয়ে অসময়ে স্নান সেরে অভাগী জ্বরে পড়ে। অভাগীর জ্বর ক্রমাগত বেড়ে চলে। জ্বরের ঘোরে অভাগী ভুল বকতে থাকে।

কাঙালী মায়ের অসুস্থতা দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। গ্রামে কোনো কবিরাজ ছিল না। অন্য গ্রামে তার বাস। কাঙালী কবিরাজের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে, হাতে পায়ে ধরে। ঘটি বাঁধা দিয়ে তাকে এক টাকা দক্ষিণা দেয়, তবু কবিরাজ অভাগীর বাড়ি আসেনি। কেবল গোটা চারেক বড়ি কাঙালীর হাতে দিয়ে দেয়। কাঙালীর মা বড়ি কটি ছেলের হাত থেকে নিয়ে আগুনে ফেলে দেয়। ছেলেকে সে বলে যে “বাগদী দুলের ঘরে কেউ কখনো ওষুধ খেয়ে বাঁচে না।” অভাগী দরিদ্র রমণী। তার জীবনে একটিমাত্র সাধ ছিল সে মৃত্যুর আগে যেন স্বামীর পায়ের ধূলা নিতে পারে আর মৃত্যুর পর যেন পুত্র তার মুখে আগুন দেয়। অভাগী সারাজীবন কষ্ট পেয়েছিল । তাই সে আর বাঁচতে চায়নি। মুখুয্যে গিন্নীর দাহকার্য দেখে তার মনে হয়েছিল যে মুখুয্যেগিন্নী হয়ত স্বর্গে যাচ্ছেন রথে চড়ে। অভাগীও স্বর্গ প্রত্যাশী। তাই স্বর্গে যাওয়ার আকাঙ্খায় অভাগী বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই কাম্য বলে মনে করেছিল।

3। সে যে মার খাইল, কি তাহার অপরাধ ছেলেটা ভাবিয়াই পাইল না। -কার উক্তি? কোন প্রসঙ্গে এই উক্তিটি করা হয়েছে? ছেলেটা কেন মার খেয়েছিল। তার পরিচয় দাও।

 

উত্তর : অভাগীর স্বর্গ গল্পে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন স্বয়ং লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মায়ের মৃত্যুর পর তার দাহকার্য করবার জন্য কাঙালী গিয়েছিল জমিদার বাড়িতে গাছ কাটার অনুমতি আনতে। কিন্তু জমিদার তাকে গাছ কাটার অনুমতি দেয়নি। উপরন্তু তাকে প্রহার করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। শরৎচন্দ্র জমিদার শ্রেণির নিষ্ঠুরতা বোঝাতে এই মন্তব্যটি করেছেন। অভাগীর সাধ ছিল যে মৃত্যুরপর তাকে যেন কবর না দিয়ে দাহ করা হয়। মুখুয্যে গিন্নীর দাহকার্য দেখে তার মনে হয়েছিল যে মৃত্যুর আগে স্বামীর পায়ের ধুলো এবং মৃত্যুর পর পুত্রের হাতের আগুন পেলে স্বর্গবাস অনিবার্য। অভাগী তাই জেনে অনুরোধ করে গিয়েছিল যে মৃত্যুর পর তারা যেন তার দাহকার্যের ব্যবস্থা করে দেয়। মৃত্যুর আগে পুত্রকে দিয়ে সে স্বামীকে ডেকে পাঠায়। স্বামীর পায়ের ধুলো নিয়ে অবশেষে অভাগী মারা যায়।

অভাগীর বাড়ির উঠোনে ছিল একটি বেলগাছ। এই বেলগাছটি সে নিজের হাতে পুঁতে ছিল। রসিক দুলে বেলগাছটি কাটতে আরম্ভ করে। কিন্তু জমিদারের দারোয়ান সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে। জমিদারের সম্পূর্ণ অনুমতি না নিয়ে গাছ কাটার জন্যে সে রসিক দুলেকে চড় মারে। কাঙালী এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। কাঙালী ভেবেছিল যে দারোয়ান হয়ত ঘুষের লোভে গাছ কাটতে বাধা দিচ্ছে। জমিদারের কাছে গেলে সে সুবিচার পাবে। তাই কাঙালী জমিদার বাড়িতে ছুটে যায়। জমিদার থাকত অন্য জায়গায়। আর জমিদার বাড়িতে থাকত গোমস্তা অধর রায়। গোমস্তা কাঙালীকে অশৌচ অবস্থায় ঘরের ভিতর ঢুকে পড়তে দেখে রেগে যায়। সব শুনে সে কাঙালীকে বলে “দুলের মড়ায় কাঠ কি হবে শুনি।” এই একই কথা তাকে বলেছে মুখুয্যে বাড়ির পুরোহিত ভট্টাচার্য মহাশয়। “তোদের জাতে কে কবে আবার পোড়ায় রে।” কাঙালী গোমস্তার কাছে কান্নাকাটি করে কিন্তু শত উপরোধেও গোমস্তার হৃদয় গলেনি। সে গাছের জন্য পাঁচ টাকা মূল্য দাবি করে। গোমস্তা যখন তাকে বলেছিল— “কার বাবার গাছে তোর বাপ কুড়ুল ঠেকাতে যায়।” তখন কাঙালী তাকে বলেছে, “সে যে আমার মায়ের হাতে পোঁতা গাছ।” গোমস্তা অধর রায় মুখের ওপর এই জবাব সহ্য করতে পারেনি। পাড়েকে ডেকে সে কাঙালীকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে আদেশ করেছে। পাঁড়ে কাঙালীকে। গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। কাঙালী কোন অন্যায় করেনি। মায়ের দাহকার্যের জন্য সে গাছের ওপর ন্যায্য দাবি পেশ করেছিল। তবু তাকে অন্যায় ভাবে মার খেতে হয়েছে। জমিদার ও তার কর্মচারীর নিষ্ঠুর রূপটি এই ঘটনায় প্রতিফলিত হয়েছে।

 

অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর

অভাগীর স্বর্গ গল্প প্রশ্ন উত্তর | রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর ২০২৪

 

১। অভাগীর স্বর্গ গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার কর

 

উত্তর : অভাগীর স্বর্গ গল্পটির নামকরণে লেখক যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ‘অভাগী’ গল্প কাহিনিটির প্রধানা নারী চরিত্র। অভাগীর স্বর্গ বলতে লেখক দেখিয়েছেন কোন দূর লোকের স্বর্গের ছবি নয়। আমাদের এই ধূলি-ধূসরিত মর্ত্য সীমারই ছবি। যে মর্ত্য অভাগীর স্বপ্নসুধায় স্বর্গের মতই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাহিত্যের নাম কাহিনিবাচক, চরিত্রবাচক, সময়বাচক, প্রতীকবাচক, অর্থাৎ ব্যঞ্জনাময় ইত্যাদি প্রকার হতে পারে। শরৎচন্দ্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের কাহিনি কিংবা চরিত্রবাচক নামকরণ করেছেন। অভাগীর স্বর্গ নামটি আপাতদৃষ্টিতে কাহিনিবাচক। কিন্তু এই নামকরণের পশ্চাতে লেখকের একটি গূঢ় অভিসন্ধি বর্তমান। সেদিক থেকে নামটি ব্যঞ্জনাময় ।

অভাগী জন্ম অভাগী। তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা মরেছিল। বাপ রাগ করে তার নাম দিয়েছিল অভাগী। লেখক লিখেছেন, “কাঙালীর মার জীবনের ইতিহাস ছোট, কিন্তু সেই ছোট্ট কাঙাল-জীবনটুকু বিধাতার এই পরিহাসের দায় হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল। তাহাকে জন্ম দিয়া মা মরিয়াছিল। বাপ রাগ করিয়া নাম দিল অভাগী। মা নাই, বাপ নদীতে মাছ ধরিয়া বেড়ায়, তাহার না আছে দিন না আছে রাত। তবু যে কি করিয়া ক্ষুদ্র অভাগী একদিন কাঙালীর মা হইতে বাঁচিয়া রহিল সে এক বিস্ময়ের বস্তু।” অভাগীর শৈশব কেটেছিল অনাদরে ও দারিদ্র্যে। বড় হওয়ার পর তার বিয়ে হয় রসিক বাগের সঙ্গে। কিন্তু বাগের অন্য বাঘিনী ছিল। তার বিয়ের পরই সে অভাগীকে ত্যাগ করে। অভাগী শিশুপুত্রকে নিয়ে গ্রামেই পড়ে থাকে।

অভাগী যে সমাজের মেয়ে তাতে স্বামী ত্যাগ করার পর অন্যজনকে নিকে করতে কোন বাধা ছিল না। অনেকে তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পরামর্শ দিয়েছিল। কেউ কেউ তাকে বিয়ের জন্য অনেক উৎপাত উপদ্রবও করেছিল। কিন্তু অভাগী ছেলের মুখ চেয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। লোককে সে বলত “কাঙালী বাঁচলে আমার দুঃখ ঘুচবে, আবার নিকে করতে যাব কিসের জন্যে।” অবশেষে দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যেই কাঙালী বড় হল। ১৫ বছরের কাঙালী একটা বেতের দোকানে কাজ করে। সবেমাত্র একটু সুখের মুখ যখন অভাগীর দেখার সময় হল তখনই সে মারা গেল। অভাগী তাই জন্মদুঃখী। অভাগীর স্বপ্ন ছিল মৃত্যুর পর ছেলের হাতের আগুন পেয়ে সে স্বর্গে যাবে। স্বামীপুত্রকে ফেলে বামুনপাড়ার ঠাকুরদাস মুখুজ্যের স্ত্রী যেদিন মারা গেল অভাগী সেদিন শ্মশানঘাটে দুরে দাঁড়িয়ে দাহকার্য দেখেছিল। ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে তার মনে হয়েছিল মুখুয্যে গিন্নী রথে চড়ে স্বর্গে যাচ্ছেন। তাই অভাগীর সাধ হয়েছিল সেও মরার পর স্বর্গে যাবে। তাই তার শেষ মিনতি ছিল মৃত্যুর পর তাকে যেন দাহ করা হয়।

কিন্তু অভাগীর যখন মৃত্যু হল তখন তাকে দাহ করার মত কাঠ জোগাড় করতে পারল না কাঙালী। নিজের বাড়ির বেল গাছটি তার বাবা রসিক দুলে কাটতে গিয়েছিল। কিন্তু জমিদারের দারোয়ান তাকে কাটতে দেয়নি। কাঙালী জমিদারের গোমস্তা অধর রায়কে অনেক অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অধর রায় গাছের জন্য পাঁচ টাকা দাম চেয়েছিল। জমিদারের গোমস্তা কাঙালীকে ঘর থেকে দারোয়ান দিয়ে বার করে দেয়। কাঙালী গিয়েছিল মুখুয্যেদের বাড়ি থেকে কিছু কাঠ চাইতে। কিন্তু মুখযোদের বাড়িতে তখন শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে। দুলে জাত তাদের দৃষ্টিতে ছোটলোক। তাই ছোটলোকের ঘরের মৃতদেহ বামুন কায়েতের ঘরের মৃতদেহের মত পোড়াবার দরকার নেই। মুখে আগুন ঠেকিয়ে মাটিতে পুঁতে দিলেই যথেষ্ট। কাঙালী অপমানিত হয়ে মুখুয্যেবাড়ি থেকে ফিরে আসে। সবদিক থেকে বিফল মনোরথ কাঙালী মায়ের মুখে এক আঁটি খড়ের আগুন ঠেকিয়ে নদীর চড়ায় পুঁতে দেয়। সেই এক আঁটি খড় থেকে যে সামান্য ধোঁয়া বেরিয়েছিল সেই কুণ্ডলায়িত ধোঁয়ার দিকে সে অপলকে তাকিয়ে থাকে। অভাগী মৃত্যুর আগে তাকে বলেছিল, “ছেলের হাতের আগুন রথকে যে আসতেই হবে। কাঙালী যেন মনে মনে ভাবে তার মাও সতীলক্ষ্মীর মত স্বর্গে চলেছে। অভাগীর স্বর্গ রচিত হয়েছিল তার ছেলেকে ঘিরে। স্বামী পুত্রকে রেখে সে স্বর্গে যেতে চেয়েছিল। সমাজের হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতায় তার হয়ত শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। তবে নিঃসন্দেহে সে মহিয়সী, নারী। শরৎচন্দ্র যেন বলতে চেয়েছেন যে যদি সত্যি স্বর্গ বলে কিছু থাকে তবে অভাগীর সেই স্বর্গবাস অবশ্যম্ভাবী। তাই শরত্তন্ত্র অভাগীর স্বর্গ নামকরণ করে এই প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন। যে সমাজ জাতপাতকে সবচেয়ে বড় বলে মনে করে সেই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অভাগীর স্বর্গ নিঃসন্দেহে এক মূর্তিমা প্রতিবাদ। তাই অভাগীর স্বর্গ নামকরণটি যথেষ্ট তাৎপর্যমণ্ডিত।

 

2. অভাগীর চরিত্রটি বিচার করো ।

 

উত্তর : অভাগীর স্বর্গের প্রধান নারী চরিত্র অভাগী । অভাগীর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক লিখেছেন কাঙ্গালীর মার জীবনের ইতিহাস ছোট কিন্তু সেই ছোট্ট কাঙাল জীবনটুকু বিধাতার এই পরিহাসের দায় হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল। তাহাকে জন্ম দিয়া মা মরিয়াছিল বাপ রাগ করিয়া নাম দিল অভাগী। মা নাই, বাপ নদীতে মাছ ধরিয়া বেড়ায়, তাহার না আছে দিন, না আছে রাত। তবু যে করিয়া ক্ষুদ্র অভাগী একদিন কাঙালীর মা হইতে বাঁচিয়া রহিল সে এক বিস্ময়ের বস্তু।” অভাগীর জীবনের তিনটি স্তর। প্রথম স্তরটি হল তার শৈশব অবস্থা। দ্বিতীয় স্তরটি তার বিবাহিত জীবন। তৃতীয় স্তরটি স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীর সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই এবং চিরবঞ্চিতা নারীর মৃত্যু পর্যন্ত জীবন সংগ্রামের কাহিনি।

অভাগী দরিদ্র ঘরের মেয়ে। তার জন্ম মুহূর্তে মা মারা গিয়েছিল। মায়ের স্নেহ সে পায়নি। মায়ের মৃত্যুর পর পিতা সংসারে অনাসক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই বাবার স্নেহ সে পায়নি। বহু কষ্টে অভাগী বড় হয়। যৌবনে উপনীত অভাগীর সঙ্গে বিয়ে হয় রসিক বাঘের। কিন্তু বাগের অন্য বাগিনী ছিল, ইহাকে লইয়া সে গ্রামান্তরে উঠিয়া গেল, অভাগী তাহার অভাগ্য ও শিশুপুত্ৰ কাঙালীকে লইয়া গ্রামে পড়িয়া রহিল।” অতঃপর স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীর জীবন-সংগ্রামের পরবর্তী কাহিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। স্বামী পরিত্যাগ করার পরে পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকে অভাগীকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বলেছিল। সামাজিক দৃষ্টিতে স্বামী ত্যাগ করলে জেলেঘরের বউয়ের দ্বিতীয়বার নিকে করার কোন দোষ ছিল না। যুবতী অভাগীকে বিয়ে করার জন্যে গ্রামের দু’একজন উপদ্রব করেছিল। কিন্তু অভাগী টলেনি। সবাইকে সে বলত, “কাঙালী বাঁচলে আমার দুঃখ ঘুচবে। আবার নিকে করতে যাব কিসের জন্যে? “কাঙালীকে অবলম্বন করেই অভাগী বাঁচতে চেয়েছিল। অবশেষে কাঙালী বড় হল। ১৫ বছরের কাঙালী বেতের দোকানে কাজ নিল। অল্পস্বল্প পয়সা পেত। বাড়ির উঠোনে যেটুকু সবজি হত তা বিক্রি করে মা ও ছেলের গ্রাসাচ্ছাদন হত। সমাজের বিশেষ করে দুলে পাড়ায় অভাগীর সতীলক্ষ্মী বলে নাম রটে গিয়েছিল। অভাগীর জীবনের সবচেয়ে বড় সাধ ছিল স্বামীর পায়ের ধুলো নিয়ে সে সধবা অবস্থায় মারা যাবে। উঁচু জাতের লোকের মতই তাকে শ্মশানে পোড়ানো হবে। আর ছেলে তার মুখে আগুন দেবে। মুখুয্যেবাড়ির গিন্নী যেদিন মারা যায় সেদিন অভাগী হাটে না গিয়ে শ্মশানে দাহকার্য দেখতে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল ছেলের হাতের আগুন পেয়ে মুখুয্যেগিরী যেন রথে চড়ে স্বর্গে গেলেন। তাই জ্বরের ঘোরে অভাগী পুত্র কাঙালীকে বলেছে, “তোর হাতের আগুন যদি পাই বাবা, বামুন-মার মত আমিও স্বর্গে যেতে পার।” অভাগীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, “ছেলের হাতের আগুন—রথকে যে আসতেই হবে।” অবশেষে অভাগী মারা গেল। মৃত্যুর আগে সে স্বামীর পায়ের ধুলো পেয়েছিল। মৃত্যুর পর ছেলের হাতের আগুনও সে পেয়েছিল। কিন্তু তার দাহকার্য হয়নি। কারণ না জমিদার না মুখুয্যে কেউ কাঙালীকে সামান্য কাঠ দেয়নি। জমিদার কাঙালীর নিজের উঠোনের গাছ কাটার জন্যেও পাঁচ টাকা মূল্য ধার্য করেছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর সমাজে মানুষের হৃদয়হীনতায় অভাগীর দাহকার্য হোক আর না হোক অভাগী নিঃসন্দেহে মহিয়ষী মহিলা। বাস্তব বিচারে সে নিঃসন্দেহে অভাগী। কিন্তু অভাগীর আদর্শ, ত্যাগ সংসারের সবার কাম্য। তাই অভাগী তার নাম হলেও এমনকি দুর্ভাগ্য তার সারা জীবনের সঙ্গী হলেও সে যথার্থ সৌভাগ্যবতী নারী। শরৎচন্দ্র অভাগী চরিত্র নির্মাণ করে জাতপাতের দ্বন্দ্বে জীর্ণ হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরেছেন এবং তথাকথিত অর্থে এক নিচু ঘরের মহিলার মধ্যে স্বর্গের দেবীর সুষমাকে আবিষ্কার করেছেন।

 

৩। কাঙালী চরিত্রটি বিচার করো।

 

উত্তর : অভাগীর একমাত্র পুত্র কাঙালী। কাঙালী পনেরো পছরের বালক। শরৎচন্দ্রের গল্পে উপন্যাসে এরকম বালক চরিত্র মাঝে মাঝেই দেখা যায়। যেমন রামের সুমতি গল্পের রাম। কাঙালী একটি সরল হৃদয় বালক। সে লেখাপড়া শেখেনি কিন্তু তার হৃদয় উদার। এই শিশু চরিত্রটিকে সামনে রেখে শরৎচন্দ্র জাতপাত ভেদাভেদে দীর্ণ হিন্দু সমাজের একটি চূড়ান্ত অবক্ষয়ের ছবি তুলে ধরেছেন।

অভাগী দুলে ঘরের বৌ। সমাজে কাঙালীর মা নামেই সে অধিক পরিচিত। লেখকও তাকে বার বার কাঙালীর মা বলে উল্লেখ করেছেন। অভাগীর জন্ম মুহূর্তেই তার মা মারা গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সংসার সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়েছিল। অভাগী বাবা ও মায়ের স্নেহ পার নি। বিয়ের পর সে স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। সংসারে তার একমাত্র অবলম্বন ছিল পুত্র কাঙালী।

কাঙালীর গল্পে উপস্থিতি পনেরো বছর বয়সে। শৈশব থেকে পনেরো বছর বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার কোন পরিচয় লেখক দেন নি। কাঙালী পনেরো বছর বয়সেই এক বেতের দোকানে কাজ নিয়েছিল। যেদিন সে কাজ শিখতে যেতো সেদিন সে জলপানির জন্য দু’টো পয়সা পেত। কাঙালী মায়ের দুঃখ ঘোচানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করত। কাঙালীর বয়স বছর পনেরো হলেও তার শৈশবত্ব তখনো কাটে নি। মায়ের কাছে শুয়ে সে রাজপুত্র, কোটালপুত্র, পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প শুনত। মা ছাড়া কাঙালীর জীবনে আর কিছু ছিল না। মায়ের প্রতি কাঙালীর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। অভাবের সংসারে প্রায়ই তাদের খাবার টানাটানি পড়ত। এই জন্য কাঞ্জলী ভাতের হাঁড়ির ঢাকা খুলে দেখে নিত মায়ের খাবার মতো ভাল আছে। কি না! এই ছলনায় কাঙালীর মা কাঙালীর মা কাঙালীকে বহুদিন ফাঁকি দিয়েছে। মা ও ছেলের এই ছলনাটুকু লেখক চমৎকার ভাবে অঙ্কন করেছেন। কাঙালীর মা কোনদিন ছেলেকে সংসারের কাজ করতে দেয় নি। তাই মা যেদিন অসুস্থ হল সেদিন অনভ্যস্ত হাতে রান্না করতে গিয়ে কাঙালী ভাতের ফ্যান ফেলেছে, ভাত ফেলেছে। কাঙালী তার মায়েরই ছায়া। মায়ের প্রতি কাঙালীর গভীর টানটি নানা ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। কালীকে তার মা বলে গিয়েছিল মৃত্যুর পর তাকে দাহ করতে। মুখুয্যে বাড়ির গিন্নী ছেলের হাতের আগুন পেয়ে যে রথে চড়ে স্বর্গে গেছেন এই বিশ্বাস অভাগীর মনে দৃঢ় হয়েছিল। কাঙালী তাই চেষ্টা করেছিল মৃত্যুরপর মাকে দাহ করতে। কাঙালী চরিত্রটির দৃঢ়তার দিকটিও লেখক অঙ্কন করেছেন। জমিদারের দারোয়ান গাছ কাটার অপরাধে যখন তার বাবা রসিক দুলেকে চড় মেরেছে তখন শিশু কাঙালী প্রতিবাদ করেছে। গাছ কাটার অনুমতি আনার জন্য সে ছুটে গেছে জমিদারের ঘরে। গোমস্তার কাছে সে গাছ কাটার অনুমতি চেয়েছে। অনুমতি না পেয়ে সে গোমস্তার মুখের ওপর তর্ক করেছে, “সে যে আমাদের উঠানের গাছ বাবুমশাই। সে যে আমার মায়ের হাতে পোঁতা গাছ।” জমিদারের গোমস্তার কাছ থেকে গাছ কাটার অনুমতি না পেয়ে কাঙালী ছুটে গিয়েছিল মুহুয্যে মশাই-এর ঘরে। কিন্তু মুখুয্যে গিন্নীর শ্রাদ্ধের জন্য দুখুয্যের ঘরে মা মণ কাঠ মজুত থাকলেও মুখুয্যে কাঙালীকে কাঠ দেয় নি। বরং নীচু জাত বলে তাকে অবজ্ঞা করেছে। সমাজের এই নিষ্ঠুরতা দেখে কাঙালীর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। লেখক বলেছেন, “কাঙালী আর প্রার্থনা করিল না। এই ঘন্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায় সংসারে সে যেন একেবারেই বুড়া হইয়া গিয়াছিল।” কাঙালী চরিত্রটি লেখকের সহানুভূতিধন্য। তার নাম কাঙালী হলেও এই অল্প বয়সের শিশুটির হৃদয়ের মাধুর্য আমাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করে।

 

4. রসিক দুলে স্ত্রী অভাগীর কোন দায়িত্ব নেয় নি তবু চরিত্রটিকে একেবারে হৃদয়হীন বলা যায় না-আলোচনা করো।

 

উত্তর : ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটিতে রসিক দুলে চরিত্রটির ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। গল্প থেকে জানা যায় যে দরিদ্রা, সংসারে অবহেলিতা অভাগীর বিয়ে হয়েছিল রসিক দুলের সঙ্গে। লেখক লিখেছেন, “যাহার সহিত বিবাহ হইল তাহার নাম রসিক বাগ। বাগের অন্য বাগিনী ছিল, ইহাকে লইয়া সে গ্রামান্তরে উঠিয়া গেল। অভাগী তাহার অভাগ্য ও শিশুপুত্র কাঙালীকে লইয়া গ্রামেই পড়িয়া রহিল।” অভাগীর বিবাহের পর রসিক দুলের এই সামান্য বর্ণনা ছাড়া তার আর বিশেষ পরিচয় জানা যায়। না। কাহিনিতে রসিক দুলের পুনরায় আগমন ঘটেছে পনেরো বছর পর। অভাগী মুখুয্যে গিন্নীর দাহকার্য দেখে ভেবেছিল যে তারও যেন স্বামীর পায়ের ধূলো নিয়ে মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর পুত্র যেন তার মুখে আগুন দেয়। আর অন্যান্য দুলে বৌদের মতো তাকে মাটিতে কবর না দিয়ে যেন তার দাহ করা হয়। অভাগী অসুস্থ হওয়ার পর জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছে। ছেলে ঘাট বাঁধা দিয়ে তার জন্য অভাগীর মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে রসিকের আগমন, স্বেচ্ছায় নয়, অভাগীর প্রার্থনায়। আবার কাহিনি। থেকে তার অন্তর্হিতিও আকস্মিক। দায়িত্ব অসমাপ্ত রেখেই তার অন্তর্ধান ঘটেছে। তবু চরিত্রটিকে একেবারে হৃদয়হীন বলা যায় না। জীবিত স্ত্রীর ভরণ-পোষণের কোন দায়িত্ব সে নেয়নি কিন্তু মুমূর্ষু স্ত্রীর কাছে দাঁড়িয়ে তার চোখে জল এসেছে। এই সামান্য ঘটনাতেই চরিত্রটি বহু অপরাধ সত্ত্বেও পাঠকের সহানুভূতি অর্জন করেছে। ওষুধ কিনে এনেছে কিন্তু ওষুধ সে আগুনে ফেলে দিয়েছে। কারণ মৃত্যুই তখন তার কাম্য। মনে মনে আসন্ন মৃত্যুর কথা জানতে পেরে সে কানে কানে পুত্রকে বাবাকে ডেকে আনার অনুরোধ জানিয়েছে। পুত্রের কাছ থেকে অভাগীর অসুস্থতার খবর পেয়ে রসিক দুলে মুমুর্ষা স্ত্রীর কাছে এসে পৌঁছেছে। রসিক যখন এসে পৌঁছায় তখন অভাগীর আর জ্ঞান নেই, মুখের ‘পরে মরণের ছায়া পড়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে অভাগী স্বামীর পায়ের ধুলো নিয়েছে। লেখক লিখেছেন, “রসিক হতবুদ্ধির মতো দাঁড়াইয়া রহিল। পৃথিবীতে তাহারও পায়ের ধুলার প্রয়োজন আছে, ইহাও কেহ না কি চাহিতে পারে তাহা তাহার কল্পনার অতীত।” স্ত্রীকে পায়ের ধুলো দিতে গিয়ে রসিক কেঁদে ফেলেছে। রসিকের মানবিক সহানুভূতির একটি অনবদ্য চিত্র অঙ্কন করেছেন গল্পকার, “জীবনে যে স্ত্রীকে সে ভালোবাসা দেয় নাই, অশন-বসন দেয় নাই, কোন খোঁজ খবর করে নাই, মরণকালে তাহাকে সে শুধু একটু পায়ের ধুলা দিতে গিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।” রাখালের মা রসিককে অনুরোধ করেছে অভাগীর দাহকার্যের ব্যবস্থা করে দিতে। রসিক নিজের শেষ কর্তব্যটুকু অস্বীকার করতে পারে নি। সে কুড়ুল হাতে নিয়ে কুটির প্রাঙ্গণে অভাগীর নিজের হাতে পোঁতা বেলগাছটি কাটতে গেছে। জমিদারের দারোয়ান এসে এই গর্হিত অপরাধের জন্য তার গালে চড় মেরেছে। রসিক তার কোন প্রতিবাদ করেনি। এই অংশেই রসিক চরিত্রের অন্তর্ধান ঘটেছে।

 

১০। ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে দুটি নারীর মৃত্যু দৃশ্য অঙ্কন করেছেন লেখক — দুই নারী কে কে? এই বিপরীত দৃশ্য অঙ্কনের মধ্য দিয়ে লেখকের কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে?

 

উত্তর : কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র তাঁর ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে দুই সতী-সাধবীর মৃত্যু দৃশ্য অংকন করেছেন। গল্পের প্রথমে রয়েছে ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রীর সৎকারের চিত্র, আর অন্যটি দুলেঘরের বউ কাঙালীর মা অভাগীর। শরৎচন্দ্র এই দুটি মৃত্যুদৃশ্য অঙ্কন করে সমাজের উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মানুষের অবস্থানগত পার্থক্যটি নির্দেশ করেছেন। ঠাকুরদাস মুখুয্যে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষ। ধানের কারবার করে তিনি পয়সা করেছেন। তাঁর চার ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেমেয়েদের ছেলেপুলে হয়েছে। পুত্র, পুত্রবধূ, জামাই, মেয়ে, নাতি-নাতনি, লোকলস্কর মিলে ঠাকুরদাসের জমজমাট সংসার। এইরকম পরিস্থিতিতে পঞ্চাশ বছর পার করে মারা গেলেন মুখুয্যেগিন্নী। মুখুয্যেগিন্নীকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। আয়োজনের অভাব ছিল না। ঘৃত, মধু, ধূপ, ঘৃনা সবকিছু নিয়ে এক এলাহি কাণ্ড। মুখযোগিরীর রাঙ্গা পা দুখানি তকতকে আলতায় সজ্জিত। তাকে শোয়ানো হল চিতা সজ্জায়। বহু কন্ঠের হরিধ্বনির মধ্য দিয়ে তার পুত্র মুখাগ্নি করল । দূরে দাঁড়িয়ে স্বামী পরিভাষা দুলে বউ অভাগী দেখছিল মুখুযো গিরীর দাহকার্য। অভাগী জন্ম থেকেই দরিদ্র। জন্ম থেকেই তার মা মরেছিল। পিতা রাগ করে নাম দিয়েছিল অভাগী। অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ হয়েছিল অভাগী। তার বিয়ে হয়েছিল রসিক বাগের সঙ্গে। রাগের অন্য বাঘিনী ছিল। বিয়ের পরেই সে অন্য গ্রামে উঠে যায়। অভাগীর একটি ছেলে হয়। ছেলের নাম । বহু কষ্ট করে অভাগী কাঙালীকে মানুষ করেছে। কাঙালীর বয়স ১৫ বছর দাঁড়িয়েছে। সবেমাত্র সে বেতের কাজ শিখতে আরম্ভ করেছে। অভাগীর আশা ছেলেকে নিয়ে তার দুঃখ ঘুচবে। অভাগী শ্মশানে দাঁড়িয়ে দেখেছিল মুখুযোগিন্নীর দাহকার্য দেখতে দেখতে তার চোখ জলে ভরে গেল। তার মনে হল যে ছেলের হাতে আগুন পেয়ে মুখুযোগিন্নী রথে চড়ে স্বর্গে যাচ্ছে। কাঙালী মাকে শ্মশান থেকে টেনে নিয়ে আসে। সেই দিনই অভাগীর জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে অভাগী বারবার স্বর্গে যাবার আকাঙ্খা প্রকাশ করে। জ্বর ক্রমাগত বেড়ে চলে। কাঙালী পাশের গাঁয়ের কবরেজের কাছ থেকে ঘটি বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করে ওষুধ এনেছিল। কিন্তু অভাগী ওষুধ খায়নি। তার তখন একটাই ইচ্ছে স্বামীর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে সে মৃত্যুবরণ করবে আর ছেলের হাতের আগুন পেয়ে সে স্বর্গে যাবে। রোগশয্যায় শুয়ে পাড়ার প্রতিবেশী সবাইকে সে নিজের অন্তিম অবস্থার কথা জানিয়ে যায়। মৃত্যু যখন আসন্ন তখন তার অনুরোধে কাঙালী গিয়ে বাবা রসিক পুলেকে ডেকে আনে। আচ্ছন্ন অবস্থায় স্বামীর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে অভাগী মারা যায়। অভাগীর শেষ ইচ্ছামত রসিক দুলে বাড়ির উঠোনে পোতা বেলগাছটি কাটতে যায়। কিন্তু জমিদারের দারোয়ান এসে রসিক দুলেকে চড় মারে। কাঙালী ছুটে যায় গোমস্তা অধর রায়ের কাছে। অধর রায় গাছের জন্য পাঁচ টাকা দাবি করে। কিন্তু পাঁচ টাকা দেবার ক্ষমতা কাঙালীর ছিল না। সকালবেলা এইরকম উপদ্রবে বিরক্ত হয়ে অধর রায় ছোট জাতের ছেলে কাঙালীকে দারোয়ান দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। নিরুপায় হয়ে কাঙালী ছুটে যায় ঠাকুরদাস মুখুয্যের বাড়িতে। একদিন পরেই মুখুয্যে বাড়িতে গিন্নীর শ্রাদ্ধের কাজ। বৃদ্ধ ঠাকুরদাস অত্যন্ত ব্যস্ত। কাঙালীর অনুরোধ মত কাঠ দেওয়ার তার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে তার নিজেরই লাগবে অনেক কাঠ। তাই দাহকার্যের জন্য সামান্য কাঠ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বৈপরীত্যের ছবিটি লেখক তীর্যকভাবে পরিস্ফুট করেছেন। মুখুয্যের ঘরে কাঙালী প্রবল অপমানিত হয়েছে। ছোটজাতের দুলেরাও যে বামুন কায়েতের সমান হতে চায় তা সহ্য করতে পারেনি মুখুয্যে তথা সমাজের উচ্চ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। ভট্টাচার্য মশাই কাঙালীকে পরামর্শ দিয়েছে— “যা, মুখে একটু নুড়ো জ্বেলে দিয়ে নদীর চড়ায় মাটি দে গে”। কাঙালী ঘরে ফিরে মাকে নিয়ে নদীর চড়ায় গিয়ে একটি খড়ের আঁটি জ্বেলে মায়ের মুখে স্পর্শ করে দেহটি মাটি চাপা দেয়। অভাগীর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। সমাজের উচ্চবৃত্ত ও বর্ণহিন্দু মানুষের নির্মমতার রূপটি লেখক পরিস্ফুট করেছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *